রক্ত আমাদের শরীরের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কারণ রক্ত আমাদের শরীরের অক্সিজেন সরবরাহ করে কাজের শক্তি বাড়ায়। এছাড়াও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে শরীরকে রোগমুক্ত রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে আমাদের শরীরে এই রক্তঅল্পতা বা রক্তস্বল্পতা দেখা দিতে পারে। দেহে বাসা বাঁধতে পারে বিভিন্ন জটিল কঠিন রোগ। এমনকি রয়েছে মৃত্যু ঝুঁকিও। তাই এই বিষয়ে আমাদের সম্যক জ্ঞান থাকা উচিৎ।

রক্তস্বল্পতা কাকে বলে?
রক্তস্বল্পতা কোনো রোগের নাম নয়। এটা মূলত রোগের এক ধরনের উপসর্গ মাত্র। যেমন- জ্বর কোনো রোগের নাম নয়, যেকোন রোগের লক্ষণ বা উপসর্গ বলা যেতে পারে। রক্তস্বল্পতাও ঠিক তেমনি। এটা ইংরেজিতে অ্যানিমিয়া নামে পরিচিত। অনেকেই আবার এটাকে রক্তশূন্যতা বা রক্তাল্পতা নামে চেনে।

রক্তস্বল্পতার কারণ কী?
কারণ বলার আগে প্রথমেই একটা কথা বুঝতে হবে যে, আমাদের শরীরে যে রক্ত থাকে তা দুই ধরনের উপাদান দিয়ে গঠিত হয়। অর্থাৎ রক্তকণিকা ও রক্তরস বা প্লাজমা। রক্তকণিকা আবার তিন ধরনের কোষ দিয়ে গঠিত অর্থাৎ লোহিতকণিকা (RBC), শ্বেতকণিকা (WBC) ও অনুচক্রিকা (Platelet)। এই লোহিতকণিকার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হলো হিমোগ্লোবিন। হিমোগ্লোবিন হলো রক্তের একটি বিশেষ রঞ্জক পদার্থ। এর প্রধান কাজ শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন সরবরাহ করা। মূলত যেকোনো কারণেই শরীরে রক্তকণিকা কমে গিয়ে রক্তস্বল্পতা হতে পারে।
রক্তস্বল্পতা মূলত তিনটি কারণে হয়।
১. অতিরিক্ত রক্তপাত বা রক্তক্ষয় অথবা রক্তক্ষরণ
২. লোহিত রক্তকণিকার উৎপাদন কমে যাওয়া
৩. লোহিত রক্তকণিকা নষ্ট হয়ে যাওয়া।

মূলত এই প্রধান তিনটি কারণে রক্তের মধ্যে আয়রনের পরিমাণ কমে গিয়ে রক্তস্বল্পতা সৃষ্টি করে। আবার খাদ্যে পুষ্টির অভাবেও রক্তস্বল্পতা হতে পারে অর্থাৎ রক্তস্বল্পতার আরেকটি কারণ বলা যেতে পারে অপুষ্টি। খাদ্যে পর্যাপ্ত আয়রন না থাকলে, হঠাৎ করে বা অনেক দিন ধরে ধীরে ধীরে শরীর থেকে যদি রক্তপাত ঘটতে থাকে এবং ফলশ্রুতিতে শরীরে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। এছাড়া ব্লিডিং পেপটিক আলসার, যকৃতের সমস্যা, পাকস্থলী বা অন্ত্রের কোনো ক্যান্সার, পাইলস, মেয়েদের মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত অথবা সন্তান জন্মের সময় রক্তক্ষরণ বা ব্লাড ক্যান্সারের কারণেও হতে পারে।
আবার অপর্যাপ্ত লোহিতকণিকা উৎপন্ন হলেও রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া হয়ে থাকে। যেমন-অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া বা অস্থিমজ্জার সমস্যা, ভিটামিন বি-১২ বা ফলিক এসিডের এবং আয়রনের অভাব, লিউকেমিয়া বা রক্তকণিকার ক্যান্সার ইত্যাদি। এছাড়া লোহিতকণিকার দ্রুত ভেঙে যাওয়া। যেমন-থ্যালাসেমিয়াতেও রক্তস্বল্পতা দেখা যায়। এছাড়াও শরীরে ভিটামিন বা আয়রনের ঘাটতির কারণেও রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।
দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ বা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরও রক্তস্বল্পতা হতে পারে। বার্ধক্যজনিত কারণেও শরীরে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।

লক্ষণ কী?
রোগীর সার্বিকভাবে রোগের ইতিহাস নিয়ে বিশেষ কোনো রোগের সন্দেহ হলে সে অনুযায়ী পরীক্ষা করা। রক্তশূন্যতায় সাধারণত যেসব লক্ষণ দেখা যায় তাহলো-
১. চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া।
২. দুর্বল লাগতে থাকা, অবসাদগ্রস্ততা ও ক্লান্তিবোধ।
৩. বুক ধড়ফড় করা।
৪. মাথা ঘোরা, মাথা ধরা, চোখে ঝাপসা দেখা।
৫. চোখ, হাত ও পা সাদাটে ও ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া।
৬. মুখে ঘা, খাবার গিলতে অসুবিধা।
৭. রক্তস্বল্পতার মাত্রা তীব্র হলে শ্বাসকষ্টসহ বুকে চাপ লাগা বা ব্যথাও হতে পারে। এমনকি হার্ট ফেইলিউরও হতে পারে।

কোন ধরনের টেস্ট করাতে হবে?
রক্তস্বল্পতা সন্দেহ হলে রক্তের একটি কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (CBC) করা জরুরি। এটির মাধ্যমে হিমোগ্লোবিনের (Hb%)) মাত্রা দেখে রক্তস্বল্পতার ভয়াবহতা পরিমাপ করা যায়। সাধারণত মেয়েদের স্বাভাবিক হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ছেলেদের স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কম থাকে। ছেলেদের রক্তের হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা ১৩-১৭ গ্রাম/ডেসিলিটার। আর মেয়েদের রক্তে সেটা থাকে ১২-১৫.৫ গ্রাম/ডেসিলিটার। এর চেয়ে কম হলে রক্তস্বল্পতা ধরা হয়। আমাদের দেশে সাধারণত ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের রক্তস্বল্পতা বেশি। এছাড়া লোহিতকণিকা (RBC)-র পরিমাণ, আকার, রঞ্জক পদার্থের ঘনত্ব ও মান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক আরবিসি ইনডেক্স (RBC Index) দেখে রক্তশূন্যতার কারণ অনুমান করতে পারেন। তবে প্রকৃত কারণ শনাক্ত করার জন্য পরে অন্যান্য পরীক্ষারও প্রয়োজন হয়। রক্তের CBC পরীক্ষা করলেই রক্তস্বল্পতা ধরা পড়ে। আয়রনের মাত্রা দেখার জন্য সেরাম আয়রন (S. Iron)) ও সেরাম ফেরিটিন (S. Ferritin) লেভেল পরীক্ষা করা যেতে পারে। প্রয়োজন হলে টিআইবিসি (TIBC) নামক এক ধরনের পরীক্ষাও করা হয়।

চিকিৎসা কী?
আসলে কী কারণে অ্যানিমিয়া হচ্ছে, সেটা আগে খুঁজে বের করতে হবে। এরপর কারণ অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে। এটাই হচ্ছে মূলকথা।
উল্লেখ্য, আয়রনসমৃদ্ধ খাবার আর ফলমূল খাওয়ার মাধ্যমে রক্তে হিমোগ্লোবিন লেভেল বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। ফলমূলে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে। প্রতিদিন আয়রনযুক্ত ফল, যেমন- আপেল, টমেটো, বেদানা, কলা, আঙ্গুর, কমলা, গাজর ইত্যাদি খেলে রক্তশূন্যতা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তাই সরাসরি আয়রন গ্রহণ করতে প্রতিদিন ২-৩টি ফল খাওয়া উচিত। শাক সবজিতেও প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে। যেমন- কচুশাক, লালশাক, কাঁচকলা, করলা, কলিজা, গিলা, ডিম, দুধ ইত্যাদি। তাই এগুলো নিয়মিত খাওয়া উচিত।

এছাড়া কিছু করণীয় রয়েছে:
* প্রচুর পরিমাণ পানি পান করতে হবে।
* নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।
* শরীরের কোথাও কেটে গেলে কিংবা ঘা হলে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা কর‍তে হবে।