পর্ব ২ এর পরবর্তী অংশ
৯। অন্য পুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষনীয় ভঙ্গিতে কথা বলা
يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِنَ النِّسَاءِ ۚ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَعْرُوفًا
“হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পরপুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষনীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, এর ফলে সেই ব্যক্তি খারাপ ধারণা করবে, যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে”। [ সুরাহ আহযাব ৩৩:৩২]
একটি মেয়ে আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বললে ছেলেরা যেমন প্রলুব্ধ হয় এর চেয়ে অনেক বেশি প্রলুব্ধ হবে তার মুখমন্ডল দর্শন করে। তাই স্বাভাবিকভাবে আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলা যেহেতু নিষেধ তাহলে ঠিক একই যুক্তিতে মুখমন্ডল প্রকাশ করাও নিষেধ। সূরা আন-নূর এর ৩১ নং আয়াতের “তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে।” এর যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে ঠিক একই ব্যাখ্যায় এই আয়াত দ্বারাও প্রমান করা যায় মুখমন্ডল অবশ্যই আবৃত করা ফরজ/ওয়াজিব বা বাধ্যতামূলক।
এবং এই আয়াতের মাধ্যমে এটাও প্রমানিত হয়, গায়রে মাহরাম পুরুষদের সাথে মেয়েদের মোবাইল ফোন এ কথা বলা, চ্যাটিং করা, ফেইসবুক এ কথা আদান প্রদান করা, ভিডিও কনফারেন্সিং, নাটক বা সিনেমায় অভিনয় ইত্যাদি সবকিছু নিষেধ হয়ে যায়।
১০। পর্দার আড়াল থেকে চাওয়া
وَإِذا سَأَلتُموهُنَّ مَتاعًا فَاسأَلوهُنَّ مِن وَراءِ حِجابٍ ۚ
“তোমরা তাঁর (নবীর) পত্নীগণের কাছে কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে”।
[সূরা আহযাব : ৩৩:৫৩]
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, অপারগ অবস্থায় পর্দার হুকুম কিছুটা শিথিল হয়ে থাকে। যেমন ধরুন ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন হলে এবং যোগ্যতাসম্পন্ন মহিলা ডাক্তার না পাওয়া গেলে নারীরা পুরুষ ডাক্তারের কাছে যেতে পারবেন। পর্দা করেই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে এবং সেক্ষেত্রে শরীরের যতটুকু অংশ না দেখালেই নয় ততটুকুই শুধুমাত্র দেখাতে পারবেন। আবার ধরুন এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো কোনো পুরুষকে কোনো নারীর হয়তো কোন একটি জিনিস দেবার প্রয়োজন হলো। তখন সে সেই বস্তুটি ঠিকই হস্তান্তর করবে কিন্তু পর্দার সহিত। উপরোক্ত আয়াত শরীফ এর দলিল।
আরো একটু মনোযোগের সাথে উপরোক্ত আয়াত শরীফ নিয়ে চিন্তা করলে আমরা বুঝতে পারবো আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা কিন্তু বলেননি পুরুষের সামনে পর্দা করে তাদেরকে যেকোনো কিছু দিতে পারো। বরং এখানে প্রথম অংশে বলা হয়েছে যদি কিছু দিতেই হয় অর্থাৎ নিতান্ত অপারগ হলে দিতে পারো। আর দ্বিতীয অংশে বলেছেন যদি সম্ভব হয় সামনে এসে নয় বরং পর্দার আড়াল থেকে দাও যেটা হচ্ছে সর্বোচ্চ ধরণের পর্দা। তাই যারা বলে থাকে বোরকা পরে যেকোনো জায়গায় যাওয়া যায় তাদের ক্ষেত্রে এই আয়াত হচ্ছে দলিল যে অপারগ না হলে মেয়েদের বোরকা পরেও পুরুষদের সামনে বিনা কারণে যাওয়া নিষেধ। । ইচ্ছেমত বোরকা পরে স্টেডিয়াম এ খেলা দেখতে গেলেও সেটাও এই আয়াত দ্বারা নিষেধ হয়ে যায়। শর্ত হচ্ছে “নিতান্ত অপারগ হলে” ।
আর একটি বিষয় খেয়াল করুন এখানে আল্লাহ তায়ালা “তোমরা” বলতে সাহাবীদের বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ সাহাবীদের বলেছেন “তোমরা” নবী পত্নীদের কাছে কিছু চাইতে হলে পর্দার আড়াল হতে চাও। সাহাবীদের মধ্যে ছিল হজরত আবু বকর (রাঃ), হজরত ওমর (রাঃ) , হজরত ওসমান (রাঃ), হজরত আলী (রাঃ) সহ সমস্ত পুরুষ সাহাবী আর নবী পত্নীদের মধ্যে ছিলেন হজরত আয়িশা (রাঃ) , হাজরাত জয়নব (রাঃ) সহ সকল নবী পত্নী গণ।
রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেন “কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম হজরত ওমর রাঃ এর ডান হাতে আমলনামা দেয়া হবে। তখন সাহাবীরা প্রশ্ন করলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ তখন আবু বকর (রা) কোথায় থাকবে?” রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন “এর আগেই ফেরেশতারা আবু বকরকে হাত ধরে জান্নাতে নিয়ে যাবে। “ (৯) এমনি ছিল সাহাবীদের মর্যাদা ।
শুধুমাত্র পুরুষ সাহাবী নন, উম্মুল মুমিনীনগণের পবিত্রতা ও মর্যাদার সাক্ষী আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা কোরআন শরীফে উল্লেখ করেছেন। উধাহরণত: আয়িশা (রাঃ) এর পবিত্রতার সাক্ষী দিয়ে আল্লাহ তায়ালা ইফকের ঘটনায় আল কোরআনের আয়াত নাজিল করেছেন যা কিয়ামত পর্যন্ত পঠিত হতে থাকবে। উম্মুল মুমিনীন গণ হলেন সমস্ত উম্মতের সম্মানিত মা এবং তাদেরকে রসূলের ইন্তেকালের পরে বিবাহ করা ছিল হারাম।
চিন্তা করুন একদিকে হজরত আবু বকর (রাঃ), হজরত ওমর (রাঃ) এর মত সম্মানিত সাহাবীগণ যারা দুনিয়াতে থাকতেই বেহেশতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন এবং অপরদিকে উম্মুল মুমিনীন যাদের পবিত্রতা আল কোরান দ্বারা প্রমাণিত তাদের উভয় দলকেই আল্লাহ তায়ালা পর্দা করতে বলেছেন!!!
আর সেক্ষেত্রে আমাদের হুকুম তাহলে কি হওয়া উচিত? আমরা কি তাদের চেয়েও অধীক মুত্তাকী পরহেজগার হয়ে গেছি যে আমাদের পর্দা করতে হবে না? আমাদের তো অবস্থা এমন সাধারণ মুসলমান থেকে শুরু করে দ্বীনি লাইন এ জড়িত ব্যাক্তিগণও দৃষ্টির হেফাজত করতে পারিনা। অনেক তরুনের শুধুমাত্র বিবাহিত নারীদের পছন্দ আবার অনেক বিবাহিত পুরুষের নিজ স্ত্রী ছাড়া আর সবাইকেই ভালো লাগে। সকালে কোনো মেয়ের দিকে দৃষ্টি গেলে প্রতি বসন্তে তার কথা মনে হয়। আর আমরাই বলি এই আয়াত তো নবী পত্নীদের জন্য নাজিল হয়েছে আমাদের জন্য নয়। যেন বলতে চাই ওনাদের পর্দা দরকার ছিল আমাদের নয়।
একজন সম্মানিত শায়খ আমাকে একটি ঘটনা বলেছিলেন। তার এক ছাত্র তার কাছে চিঠি লিখে একটি সমস্যা জানিয়েছিল। চিঠিতে সেই ছাত্র উল্লেখ করেছিল চোখ বন্ধ করে জিকির করার সময় তার এতো মেয়েদের কথা মনে হয় যে একবার গোছল ফরজ হয়ে গিয়েছিল। এই হচ্ছে আমাদের বর্তমান সমাজের চিত্র। আমাদের তাকওয়া। খুব কম মুমিন আছে যে বর্তমানে চোখের দৃষ্টি থেকে নিজেকে হেফাজত করতে পারেন।
বর্তমানে চারিপাশে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় শুধুমাত্র ধর্ষণ আর ধর্ষণ। যুবক যুবতী তো দূরের কথা চাচা দ্বারা ভাতিজি ধর্ষণ, মামা দ্বারা ভাগ্নি ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ কিছু আর বাদ নেই। জামাই শাশুড়ির সাথে পলায়ন। বিয়াই বিয়াইন এর সাথে পলায়ন এমন ঘটনাও বাদ যাবে কেন? এখন পরিবেশ এমন গায়রে মাহরাম তো দূরের কথা মাহরাম এর ক্ষেত্রেও অনেক সময় পর্দা করা ফরজ হয়ে যায়।
বর্তমানে এই ধরণের পর্দার কথা শুনলেও অধিকাংশ নারী/পুরুষ নির্বিশেষে বলে থাকেন “এটা এযুগে সম্ভব না”। “মেয়েদেরকে ঘরে বন্দি করার শামিল”, “মেয়েদেরকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করার শামিল”। বিষয়টি আসলে তা নয়। বরং বলা যায় এটা মেয়েদেরকে সম্মানিত করেছে। আমাদের ঈমান দুর্বল দেখে আমরা সুন্নত পালন করার মধ্যে আনন্দ পাই না। কোনো জিনিস ভালো না খারাপ সেটা নির্ভর করছে আপনি তার প্রতি কতটা আসক্ত তার ওপর। যাদের হৃদয়ে আল্লাহ, রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ) এবং সাহাবীদের মর্যাদা, ভালোবাসা অংকিত আছে সেই সকল মেয়েদের নিকট এক মুহূর্ত কোনো গায়রে মাহরাম পুরুষের সামনে নিজের সৌন্দর্য প্রকাশ করা সমগ্র আসমান তার মস্তকে ভেঙে পড়ার শামিল। পৃথিবীর সমস্ত কিছুর বিনিময়েও সে বেপর্দা হওয়া পছন্দ করবে না।
– পর্ব ৩ সমাপ্ত —

Leave a Comment

নিচে কমেন্ট বক্স এ আপনার মূল্যবান মতামত দিন। যা লেখকের অনুপ্রেরণা জোগাবে ইনশা-আল্লাহ।