পর্ব ৩ এর পরবর্তী অংশ
১১। হাদিস শরীফের দলিল:
এখন আমরা হাদিস শরীফ দ্বারা দেখবো মহিলা সাহাবীগণ কিভাবে মুখমন্ডল আবৃত করে পর্দা করতেন:
১২। ইহরামরত অবস্থায় আয়েশা (রাঃ) মুখমন্ডল আবৃত করা
হজরত আয়শা (রাঃ) বলেন, “যখন আমরা নবী করিম (সাঃ) এর সাথে ইহরাম রত অবস্থায় ছিলাম সে সময় পুরুষরা আমাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় আমরা আমাদের মুখমন্ডলের ওপর কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতাম। যখন তারা চলে যেত তখন আমরা মুখমন্ডল অনাবৃত করে ফেলতাম। [ ১। মুসনাদে ইবনে হাম্বল (রহঃ) ৩০/৬, ২। সুনানে ইব্নে আবু দাউদ ১০৪/২ , ৩। সুনানে ইবনে মাজাহ ৯৭৯/২ ]
অধিকাংশ আলেমদের মত হল, ইহরাম অবস্থায় মহিলারা মুখ ঢাকতে পারবে না কিংবা বলা যায় মুখমন্ডল নিকাব স্পর্শ করে এমনভাবে মুখ ঢাকতে পারবে না। অথচ এখানে স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে আয়িশা (রাঃ) ইহরামরত অবস্থায় গায়রে মাহরাম পুরুষদের সম্মুখে মুখমন্ডল আবৃত করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সময়ের সুপ্রসিদ্ধ সম্মানিত সালাফি শায়খ আল মুনাজ্জিদ সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন যা নিম্নরূপ:
“ইহরামরত অবস্থায় মহিলাদের মুখমন্ডল অনাবৃত রাখা বাধ্যতামূলক যা অধিকাংশ আলেম বলছেন। এবং অন্য কোনো হুকুম এই হুকুমকে বাতিল করতে পারে না যদি না সেই হুকুমও বাধ্যাতামূলক হয়। যদি গায়রে মাহরাম এর সামনে মুখমন্ডল আবৃত করা বাধতামূলক না হতো তাহলে ইহরাম রত অবস্থায় অবশ্যই মুখমন্ডল অনাবৃত রাখতে হত। সহিয়াইন (বুখারী ও মুসলিম শরীফ এর হাদিস) দ্বারা প্রমাণিত ইহরাম অবস্থায় মুখমন্ডল স্পর্শ করে মুখ আবৃত করা নিষেধ। (যেহেতু দুটো নিষেধ সামনে এসেছে এবং একসাথে দুটোই পালন করা সম্ভব নয় তাই আয়িশা (রাঃ) মুখমন্ডল আবৃত করাটা বেছে নিয়েছেন)
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইয়িমা (রহঃ) বলেন, “এই বিষয়টি ইঙ্গিত করে ইহরামরত ছাড়া অন্য অবস্থায়ও নিকাব এবং হাত-মোজা সাধারণভাবে প্রচলিত ছিল। এতে বুঝা যায় (তৎকালীন সময়ে মুসলিম মেয়েরা) মুখ ও হাত আবৃত করতো।” (৭)
১৩। শাহাদৎ প্রাপ্ত সন্তানের মায়ের মুখে নেকাব থাকা
উম্মে খাল্লাদ নামক একজন মহিলা সাহাবী রসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর দরবারে নেকাব আবৃত করে আসলেন। এসেই তিনি তার নিহত সন্তান বিষয়ে প্রশ্ন করলেন। এক সাহাবী বললেন, “আপনি আপনার নিহত সন্তান বিষয়ে প্রশ্ন করতে এসেছেন। এই মুহূর্তেও আপনি নেকাব দিয়ে মুখমন্ডল আবৃত করে এসেছেন?” জবাবে মহিলা সাহাবী বললেন, “আমার সন্তান মারা যেতে পারে কিন্তু আমার আব্রু তো মারা যায়নি” [ আবু দাউদ শরীফ ২৪৯০]
আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর সাহাবীদের মর্যাদা আরো বৃদ্ধি করে দিন। তাদের মজবুত ঈমান দেখলে বিস্ময়ে শুধু হতবাক হতে হয়। মায়ের সামনে সন্তানের মৃত্যু- এরচেয়ে কঠিন বিপদ পৃথিবীতে কোনো মায়ের জন্য হয়তো নেই। এই মুহূর্তেও তাদের ঈমানের দৃঢ়তা দেখে অবাক হতে হয়। এই মুহূর্তেও তিনি শুধু নেকাব দিয়ে আসেননি, কত সুন্দর জবাব দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য উদাহরণ রেখে গেছেন। সাহাবীরা যেকোনো অসীলা খুঁজে আমল করতেন, আর আমরা যেকোন অসীলায় আমল পরিত্যাগ করার উপায় খুঁজি। মা তার সন্তানের মৃত্যুর সময়ও পর্দা করতে ভোলেনি, আর বর্তমানে দেখা যায় সচরাচর পর্দা করে এমন মা তার সন্তানের বিয়ের সময় পর্দা না করে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়!
১৪। আবু বকর (রাঃ) এর কন্যা ও মুখমন্ডল আবৃত করা
ইসমাইল বিন আবি খালিদ (রাঃ) বর্ণনা করেন, “আমরা উম্মুল মুমিনীন এর কাছে তারবিয়ার দিন গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “হে বিশ্বাসীদের মাতা, একজন মহিলা এখানে আছেন যিনি ইহরাম অবস্থায় মুখ আবৃত করতে অস্বীকার করেছেন। আয়িশা (রাঃ) তার বুকের কাপড়- এর খানিকটা নিয়ে সেই মহিলার মুখমন্ডল আবৃত করে দিলেন। [আত-তালখীসুল খবীর ২/৫৭৬]
কেউ কেউ বলে থাকেন মুখমন্ডল আবৃত করা শুধুমাত্র নবী পত্নীদের জন্য নির্ধারিত ছিল, অন্যান্য মহিলারা বা মহিলা সাহাবীগণ এটা পালন করতেন না। তাদের এই যুক্তি নিঃসন্দেহে উপরোক্ত হাদিস শরীফ খণ্ডন করে দেয়। কেননা আয়িশা (রা:) কে অভিযোগ করা হয়েছিল একজন মহিলা সমন্ধে যিনি ইহরাম অবস্থায় মুখ আবৃত করেনা। সেই মহিলা উম্মুল মুমিনীনদের কেউ ছিল না। তথাপি আয়িশা (রাঃ) কাপড়ের একটি অংশ দিয়ে তার মুখ ঢেকে দেন।
শুধু তাই নয়, আয়িশা (রা:) এর কাছে বলা হল “একজন মহিলা মুখ ঢাকছে না” এ কথার দ্বারা স্পষ্টতই প্রমাণিত হয় যে সেই মহিলা ছাড়া অন্য সবাই মুখমন্ডল ঢেকে রেখেছিলেন। অধিকাংশ মহিলা মুখ অনাবৃত রাখলে তখন নিশ্চয়ই বলা হতো অনেকে মুখ ঢাকছে না। সুতরাং যারা বলে থাকেন তৎকালে আরব মহিলাদের মধ্যে মুখ ঢাকার প্রচলন ছিল না বা উম্মুল মুমিনীন ছাড়া অন্য কেউ মুখ ঢাকতো না তাদের এই কথা বা দাবি উপরোক্ত হাদিস শরীফ দ্বারা খণ্ডন হয়ে যায়।
১৫। আবু বকর রাঃ এর কন্যা
ফাতিমাহ বিনতে আল মুনযির বর্ণনা করেন “যখন আমরা ইহরাম অবস্থায় আবু বকর রাঃ এর কন্যা আসমা (রাঃ) এর সঙ্গী ছিলাম, তখন আমরা মুখমন্ডল আবৃত করতাম।“
এই হাদিস শরীফ প্রমান করে তৎকালীন মহিলা সাহাবীরা শুধুমাত্র নিকাব দ্বারা মুখমন্ডল আবৃত করতেন তা নয়, বরং ইহরামরত অবস্থায় মুখমন্ডল আবৃত করা নিষেধ থাকা সত্ত্বেও সেই সময় তার মুখ ঢাকতেন।
১৬। মহিলাদের পা ঢেকে রাখার হুকুম
ইবনে ওমর (রাঃ) বর্ণনা করেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেন, “কেউ যদি অহংকারের সাথে কাপড় হেচড়িয়ে চলাচল করে, আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা কিয়ামতের দিন তার দিকে দৃষ্টি দিবেন না।” উম্মে সালামাহ বললেন, “মহিলারা তাহলে কাপড়ের প্রান্ত কিভাবে রাখবে?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তখন বলেন, “তারা শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখবে”, তিনি বললেন, “কিন্তু তাতেও যদি তাদের পা বের হয়ে যায়?” তিনি বললেন “তাহলে আরো ১ বিঘৎ পরিমান তারা ঝুলিয়ে দিবে, কিন্তু এর বেশি নয়” [ তিরমিযী শরীফ ]
যারা মুখমন্ডল খোলা রাখা জায়েজ বলেন তাদের কাছে একটি জিজ্ঞাসা “যদি সাধারণ ভাবে শুধুমাত্র “পা” বের করে রাখা মহিলাদের জন্য নিষেধ হয়ে থাকে যা উপরোক্ত হাদিস শরীফে আমরা দেখলাম তাহলে কোন যুক্তিতে আরো বেশি ফেতনার আশংকাযুক্ত “মুখমন্ডল” বের করে রাখা অনুমোদিত হতে পারে? মহিলাদের পা এর দিকে দৃষ্টি খুব কম পুরুষই দিয়ে থাকেন তারপরও যদি সেটা নিষেধ হতে পারে তাহলে যে মুখমন্ডল দেখে অধিকাংশ পুরুষ আকৃষ্ট হয় তাহলে কোনো যুক্তিতে সেটা নিষেধ হবে না? আপনি কি মনে করেন এমন স্ববিরোধিতা ইসলাম অনুমোদন করবে? সাধারণ বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো ব্যাক্তির এ বিষয়টি না বোঝার কথা না।
১৭। চুল দেখানোর শাস্তি
একবার হযরত ফাতেমা (রাঃ) এবং হযরত আলী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর সাথে সাক্ষাত করতে যেয়ে দেখলেন তিনি ক্রন্দন করছেন এবং ওনার দাড়ি মোবারাক ভিজে যাচ্ছে। তারা জিজ্ঞেস করলেন, “হে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আপনি কাঁদছেন কেন?” তিনি বললেন “হে ফাতেমা, আমি যখন মেরাজে গিয়েছিলাম তখন কিছু নারীকে জাহান্নামে শাস্তি পেতে দেখলাম। তাদের কথা স্মরণ করে আমি কাঁদছি। প্রথমে এক নারীকে দেখলাম তাকে জাহান্নামে তার চুল এর সাথে বেঁধে লটকিয়ে রাখা হয়েছে, সে দগ্ধ হচ্ছে এবং তার মাথার মগজ ফুটন্ত গরম পানির মতো টগবগ করে ফুটছে। (শুধুমাত্র চুল ধরে টান দিলে কি প্রচন্ড ব্যাথা অনুভূত হয়, সেক্ষেত্রে চুল এর সাথে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখলে তার কি হবে?)
হযরত ফাতেমা (রাঃ) একথা শুনে বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ কেন তাদের এরূপ শাস্তি হচ্ছে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বললেন “এসকল নারী নিজেদের চুল কাটতো এবং চুল খোলা রেখে ঘুরে বেড়াতো।”
[ আল কাবায়ের, আল্লামাহ জাহাবী (রহঃ)]
নারীদের চুল পুরুষদেরকে দেখানোর শাস্তি উপরোক্ত হাদিস শরীফে বর্ণনা করা হয়েছে। যদি চুল দেখালে এই শাস্তি হয়, তাহলে মুখমন্ডল দেখালে কেমন শাস্তি হতে পারে? নিশ্চয়ই এর চেয়ে বহুগুন বেশি যেহেতু মুখমন্ডলের সৌন্দর্য চুলের সৌন্দর্যের চেয়ে অনেকগুন বেশি যেটা বলার অপেক্ষা রাখে। প্রিয় পাঠক খেয়াল করুন কেহ যদি বলে চুল দেখালে গোনাহ হবে কিন্তু “মুখমন্ডল” দেখালে গোনাহ হবে না তাহলে কি সেটা হাস্যকর যুক্তি হয়ে যাবে না? চুল দেখানোর কারণে শাস্তি হলে মুখমন্ডল তো আরো বড়ধরণের পর্দার আওতায় পড়বে এবং তার শাস্তিও হবে আরো বেশি।
১৮। ইফকের ঘটনা এবং মুখমন্ডল আবৃত করা
এখন আমরা একটি ঘটনা বর্ণনা করব যে ঘটনার মাধ্যমে পর্দার বেশ কয়েকটি স্তর আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে যাবে। ঘটনাটি আয়েশা (রাঃ) কে নিয়ে এবং ইফকের ঘটনা নামে এটি বেশ প্রসিদ্ধ। ষষ্ঠ হিজরীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বনু মুস্তালিকদের যুদ্ধে যাবার সময় সাথে উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রাঃ) ছিলেন। ইতিপূর্বে নারীদের পর্দার বিধান অবতীর্ণ হয়েছিল। তাই হজরত আয়েশা(রাঃ) উঠের পিঠে পর্দাবিশিষ্ট আসনের মধ্যে বসা ছিলেন। (সম্মানিত পাঠক, এখানে একটি বিষয় খেয়াল করুন, উম্মুল মুমিনীনগন সম্পূর্ণ শরীর পর্দা দ্বারা আবৃত করার পরও শুধুমাত্র উঠের পিঠে বসে থাকতেন না। পৃথকভাবে পর্দাবৃত আসনের ব্যবস্থা করা হত। প্রথমে সেই আসনে সওয়ার হতেন এরপর সাহাবীরা সেই আসনকে উটের পিঠে বসিয়ে দিতেন।)
ঘটনাটি অনেক বড় এবং এখানে শেষ অংশটি বলা হচ্ছে যেটা আমাদের আলোচনার সাথে প্রাসঙ্গিক। আয়েশা (রাঃ) প্রাকৃতিক প্রয়োজনে জঙ্গলের দিকে গেলেন এবং এসে দেখলেন কাফেলা চলে গেছে। উনি সেখানেই অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেন। সাহাবী সাফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল (রাঃ) কাফেলার পিছনে দেখতে লাগলেন কিছু ফেলে যাওয়া হয়েছে কিনা। তিনি একজনকে শুয়ে থাকতে দেখে কাছে এসে হজরত আয়িশা (রাঃ) কে চিনতে পারলেন। কেননা পর্দার আয়াত নাজিল হবার পূর্বে তিনি আয়েশা (রাঃ) কে চিনতেন।
চেনার পর তিনি বিচলিত কণ্ঠে বললেন “ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন” । এই বাক্য হজরত আয়িশা (রাঃ) এর কানে যাবার সাথে সাথে তিনি ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে গেলেন এবং মুখমন্ডল ঢেকে ফেললেন। অবশেষে তিনি উটে করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর কাছে চলে গেলেন।
আমাদের ঘটনাটি বলার উদ্দেশ হলো এই ঘটনার শেষ অংশ। যখন হজরত আয়িশা (রাঃ) ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে পুরুষ সাহাবীকে দেখলেন সাথে সাথে কাপড় দ্বারা মুখমন্ডল ঢেকে ফেললেন।
[তফসীরে মাআরিফুল কোরআন : খন্ড ৬ ]
বুখারী শরীফ এবং মুসলিম শরীফে এই ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে এবং সেখানে আয়িশা (রাঃ) এর এমন বর্ণনা এসেছে যে “তিনি মুখমন্ডল জিলবাব বা ওড়না দ্বারা আবৃত করেন এবং সাফওয়ান (রাঃ) সাহাবীর সাথে একটি কথাও বলেননি।”
– পর্ব ৪ সমাপ্ত —

1 thoughts on "নারীদের মুখমন্ডল পর্দার অন্তর্ভুক্ত-পর্ব ৪"

নিচে কমেন্ট বক্স এ আপনার মূল্যবান মতামত দিন। যা লেখকের অনুপ্রেরণা জোগাবে ইনশা-আল্লাহ।