তারা মহামূল্য উপঢৌকনাদি নিয়ে হাবশা যাত্রা করেন এবং সেখানে গিয়ে প্রথমে খৃষ্টানদের নেতৃস্থানীয় পাদ্রী ও পোপদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তাদের ক্ষুরধার যুক্তি এবং মূল্যবান উপঢৌকনাদিতে ভুলে দরবারের পাদ্রী নেতারা একমত হয়ে গেল। পরের দিন আমর ইবনুল ‘আছ উপঢৌকনাদি নিয়ে বাদশাহ নাজ্জাশীর দরবারে উপস্থিত হলেন। অতঃপর তারা বললেন,
হে বাদশাহ! আপনার দেশে আমাদের কিছু অজ্ঞ-মূর্খ ছেলে-ছোকরা পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে। যারা তাদের কওমের দ্বীন পরিত্যাগ করেছে এবং তারা আপনাদের ধর্মেও প্রবেশ করেনি। তারা এমন এক নতুন দ্বীন নিয়ে এসেছে, যা আমরা কখনো শুনিনি বা আপনিও জানেন না। আমাদের কওমের নেতৃবৃন্দ আমাদেরকে আপনার নিকটে পাঠিয়েছেন, যাতে আপনি তাদেরকে তাদের কওমের কাছে ফেরৎ পাঠান’।
তাদের কথা শেষ হ’লে উপস্থিত পাদ্রীনেতাগণ কুরায়েশ দূতদ্বয়ের সমর্থনে মুহাজিরগণকে তাদের হাতে সোপর্দ করে দেওয়ার জন্য বাদশাহকে অনুরোধ করল। তখন বাদশাহ রাগতঃ স্বরে বললেন, আল্লাহর কসম! এটা কখনোই হতে পারে না। তারা আমার দেশে এসেছে এবং অন্যদের চাইতে আমাকে পসন্দ করেছে। অতএব তাদের বক্তব্য না শুনে কোনরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।
ফলে তাঁর নির্দেশক্রমে জাফর বিন আবু তালিবের নেতৃত্বে মুসলিম প্রতিনিধি দল বাদশাহর দরবারে উপস্থিত হয়ে তাঁকে সালাম দিলেন। কিন্তু সিজদা করলেন না। বাদশাহ তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা প্রথানুযায়ী আমাকে সিজদা করলে না কেন? যেমন ইতিপূর্বে তোমাদের কওমের প্রতিনিধিদ্বয় এসে করেছে? বাদশাহ আরও বললেন, বাপ-দাদার ধর্ম ত্যাগ করে এমনকি আমাদের ধর্ম গ্রহণ না করে নতুন যে ধর্মে তোমরা দীক্ষা নিয়েছে, সেটা কী আমাকে শোনাও!’
জা‘ফর বিন আবু তালিব বললেন, হে বাদশাহ! আমাদের ধর্মের নাম ‘ইসলাম’। আমরা স্রেফ আল্লাহর ইবাদত করি এবং তার সাথে কাউকে শরীক করি না। বাদশাহ বললেন, কে তোমাদের এসব কথা শিখিয়েছেন? জাফর বললেন, আমাদের মধ্যকারই একজন ব্যক্তি। ইতিপূর্বে আমরা মূর্তিপূজা ও অশ্লীলতা এবং অন্যায় ও অত্যাচারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলাম এবং আমরা শক্তিশালীরা দুর্বলদের শোষণ করতাম। এমতাবস্থায় আল্লাহ মেহেরবানী করে আমাদের মধ্যে তাঁর শেষনবীকে প্রেরণ করেছেন। তাঁর নাম ‘মুহাম্মাদ’।
তিনি আমাদের চোখের সামনে বড় হয়েছেন। তাঁর বংশ মর্যাদা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আমানতদারী, সংযমশীলতা, পরোপকারিতা প্রভৃতি গুণাবলী আমরা জানি। নবুঅত লাভের পর তিনি আমাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন এবং মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করে সর্বাবস্থায় এক আল্লাহর ইবাদত করার আহবান জানিয়েছেন। সাথে সাথে যাবতীয় অন্যায়-অপকর্ম হতে তওবা করে সৎকর্মশীল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি এবং এক আল্লাহর ইবাদত করছি ও হালাল-হারাম মেনে চলছি।
এতে আমাদের কওমের নেতারা আমাদের উপর ক্রুদ্ধ হয়েছেন এবং আমাদের উপর প্রচন্ড নির্যাতন চালিয়েছেন। সেকারণ বাধ্য হয়ে আমরা সবকিছু ফেলে আপনার রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছি আপনার সুশাসনের খবর শুনে। আমরা অন্যস্থান বাদ দিয়ে আপনাকে পসন্দ করেছি এবং আপনার এখানেই আমরা থাকতে চাই। আশা করি আমরা আপনার নিকটে অত্যাচারিত হব না’।
অতঃপর জাফর বললেন, হে বাদশাহ! অভিবাদন সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আমাদের জানিয়েছেন যে, জান্নাতবাসীদের পরস্পরে অভিবাদন হল ‘সালাম’ এবং রাসূলুলাহ (সাঃ) আমাদেরকে পরস্পরে ‘সালাম’ করার নির্দেশ দিয়েছেন।’
বাদশাহ বললেন, ঈসা ও তাঁর দ্বীন সম্পর্কে তোমরা কি বলতে চাও? উত্তরে জা‘ফর বিন আবু ত্বালিব সূরা মারিয়ামের শুরু থেকে ৩৬ আয়াত পর্যন্ত হযরত যাকারিয়া ও ইয়াহইয়া (আঃ)-এর বিবরণ, মারিয়ামের প্রতিপালন, ঈসার জন্মগ্রহণ ও লালন-পালন, দোলনায় কথোপকথন প্রভৃতি আয়াতগুলি পাঠ করে শুনিয়ে দিলেন। বাদশাহ ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক এবং তাওরাত-ইঞ্জীলে পন্ডিত ব্যক্তি।
কুরআনের অপূর্ব বাকভঙ্গি, শব্দশৈলী ও ভাষালংকার এবং ঘটনার সারবত্তা উপলব্ধি করে বাদশাহ অঝোর নয়নে কাঁদতে থাকলেন। সাথে উপস্থিত পাদ্রীগণও কাঁদতে লাগলো। তাদের চোখের পানিতে তাদের হাতে ধরা ধর্মগ্রন্থগুলি ভিজে গেল। অতঃপর নাজ্জাশী বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয়ই এই কালাম এবং ঈসার নিকটে যা নাযিল হয়েছিল দু’টিই একই আলোর উৎস হতে নির্গত’। বলেই তিনি কুরায়েশ দূতদ্বয়ের দিকে ফিরে বললেন, ‘তোমরা চলে যাও! আল্লাহর কসম! আমি কখনোই এদেরকে তোমাদের হাতে তুলে দেব না’।
আমর ইবনুল ‘আছ এবং আব্দুল্লাহ বিন আবী রাবী‘আহ দরবার থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমর বললেন, কালকে এসে এমন কিছু কথা বাদশাহকে শুনাবো, যাতে এদের মূলোৎপাটন হয়ে যাবে এবং এরা ধ্বংস হয়ে যাবে। একথা শুনে আব্দুল্লাহ বললেন, না, না এমন নিষ্ঠুর কিছু করবেন না। ওরা আমাদের স্বগোত্রীয় এবং নিকটাত্মীয় তো বটেই। কিন্তু আমর ওসব কথায় কর্ণপাত করলেন না। পরের দিন বাদশাহর দরবারে এসে তিনি বললেন,
‘হে সম্রাট! এরা ঈসা ইবনে মারিয়াম সম্পর্কে ভয়ংকর সব কথা বলে থাকে’। একথা শুনে বাদশাহ মুসলমানদের ডাকালেন। মুসলমানেরা একটু চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। কেননা নাছারারা ঈসাকে উপাস্য মানে। কিন্তু মুসলমানরা তাকে আল্লাহর বান্দা বলে থাকে। যাই হোক কোনরূপ দ্বৈততার আশ্রয় না নিয়ে সত্য বলার ব্যাপারে তারা মনস্থির করলেন এবং আল্লাহর উপর ভরসা করে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে সত্য প্রকাশ করে দিয়ে জাফর বিন আবু তালিব বললেন,
‘তিনি ছিলেন আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। তিনি ছিলেন আল্লাহ প্রেরিত রূহ এবং তাঁর নির্দেশ। যা তিনি মহীয়সী কুমারী মাতা মারিয়ামের উপরে ফুঁকে দিয়েছিলেন। কোন পুরুষ লোক তাকে স্পর্শ করেনি’।
তখন নাজ্জাশী মাটি থেকে একটা কাঠের টুকরা উঠিয়ে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! তুমি যা বলেছ, ঈসা ইবনে মারিয়াম তার চাইতে এই কাষ্ঠখন্ড পরিমাণও বেশী ছিলেন না’। তিনি একথাও বলেন যে, ‘আল্লাহর শোকর যে, আমি এই রাসূলের যামানা পেয়েছি’।
তিনি জাফর ও তার সাথীদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘যাও! তোমরা আমার দেশে সম্পূর্ণ নিরাপদ। যে ব্যক্তি তোমাদের গালি দেবে, তার জরিমানা হবে। যে ব্যক্তি তোমাদের গালি দেবে, তার জরিমানা হবে। তোমাদের কাউকে কষ্ট দেওয়ার বিনিময়ে যদি কেউ আমাকে স্বর্ণের পাহাড় এনে দেয়, আমি তা পসন্দ করব না’। অতঃপর তিনি কুরায়েশ দূতদ্বয়ের প্রদত্ত উপঢৌকনাদি ফেরৎ দানের নির্দেশ দিলেন।
ঘটনার বর্ণনাদানকারিণী হযরত উম্মে সালামাহ (রাঃ) (পরবর্তীকালে উম্মুল মুমেনীন) বলেন, ‘ঐ দু’জন চরম বেইযযতির সাথে দরবার থেকে বেরিয়ে গেল… এবং আমরা উত্তম প্রতিবেশীর সাথে উত্তম গৃহবাসীরূপে বসবাস করতে থাকলাম’।
আবু ত্বালিবের ও খাদীজা (রাঃ)এর মৃত্যু (১০ম নববী বর্ষ)
★★★ দীর্ঘ তিন বছর বয়কট অবস্থায় থেকে গাছের ছাল-পাতা খেয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে বার্ধক্য জর্জরিত দেহ নিয়ে চাচা আবু ত্বালিব ও স্ত্রী খাদীজাতুল কুবরা চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিলেন।
আবু ত্বালিবের মৃত্যু (রজব ১০ম নববী বর্ষ):
১০ম নববী বর্ষের মুহাররম মাসে ঠিক তিন বছরের মাথায় বয়কট শেষ হওয়ার ৬ মাস পরে রজব মাসে আবু ত্বালিবের মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে আবু জাহল, আব্দুল্লাহ ইবনে আবী উমাইয়া প্রমুখ মুশরিক নেতৃবৃন্দ তাঁর শিয়রে বসে ছিল। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এসে মৃত্যুপথযাত্রী পরম শ্রদ্ধেয় চাচাকে বললেন, ‘হে চাচা! আপনি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ কলেমাটি পাঠ করুন, যাতে আমি সেটাকে আপনার জন্য প্রমাণ হিসাবে আল্লাহর নিকটে পেশ করতে পারি’।
কিন্তু এ সময় দুরাচার আবু জাহল ও আব্দুল্লাহ বিন আবু উমাইয়া বারবার তাঁকে উত্তেজিত করতে থাকে যেন তিনি পিতৃধর্ম ত্যাগ না করেন। ফলে শেষ বাক্য তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়‘আব্দুল মুত্ত্বালিবের দ্বীনের উপরে’। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলে উঠলেন,
‘আমি আপনার জন্য আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করে যাব। যতক্ষণ না আমাকে নিষেধ করা হয়’। ফলে এ সময় আয়াত নাযিল হয়-
مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا أَنْ يَّسْتَغْفِرُوْا لِ لْمُشْرِكِيْنَ وَلَوْ كَانُوْا أُوْلِيْ قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيْمِ-
‘নবী ও ঈমানদারগণের জন্য সিদ্ধ নয় যে, তারা ক্ষমাপ্রার্থনা করবে মুশরিকদের জন্য। যদিও তারা নিকটাত্মীয় হয়, একথা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর যে তারা জাহান্নামের অধিবাসী’ (তওবাহ ৯/১১৩)।
এরপরে নবীকে সান্ত্বনা দিয়ে আয়াত নাযিল হয়,
إِنَّكَ لاَ تَهْدِيْ مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللهَ يَهْدِيْ مَنْ يَّشَآءُ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِيْنَ-
‘নিশ্চয়ই তুমি হেদায়াত করতে পার না যাকে তুমি পসন্দ কর। বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়াত করে থাকেন এবং তিনি হেদায়াতপ্রাপ্তদের সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৬)।
আবু ত্বালিবের এই করুণ বিদায়ে ব্যথিত ভ্রাতা আববাস (রাঃ) একদিন ভাতিজা রাসূলের কাছে তার প্রাণপ্রিয় চাচার আখেরাতের অবস্থা কেমন হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জাহান্নামবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে হালকা আযাব প্রাপ্ত হবে আবু তালিব। তিনি আগুনের দুটি জুতা পরিহিত হবেন, যাতে তার মাথার মগয গলে টগবগ করবে’।
খাদীজা (রাঃ)-এর মৃত্যু (রামাযান ১০ম নববী বর্ষ):
স্নেহশীল চাচা আবু তালিবের মৃত্যুর মাত্র দুমাস বা তিন মাস পরে দশম নববী বর্ষের রামাযান মাসে প্রাণাধিক প্রিয়া স্ত্রী খাদীজাতুল কুবরা ‘তাহেরা’-র মৃত্যু হয়। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর এবং রাসূলের বয়স ছিল ৫০ বছর। তাঁদের দাম্পত্য জীবন স্থায়ী হয়েছিল ২৫ বছর। দীর্ঘ তিন বছর যাবৎ বয়কটকালীন নিদারুণ কষ্ট অবসানের মাত্র ৬ মাসের মাথায় চাচা ও ৮ মাসের মাথায় স্ত্রীকে হারিয়ে শত্রু পরিবেষ্টিত ও আশ্রয়হারা নবীর অবস্থা কেমন হয়েছিল, তা চিন্তাশীল মাত্রই বুঝতে পারেন।
চাচা আবু তালেব ছিলেন সামাজিক জীবনে রাসূলের জন্য ঢাল স্বরূপ। অন্যদিকে পারিবারিক ও অর্থনৈতিক জীবনে খাদীজা ছিলেন রাসূলের বিশ্বস্ততম নির্ভরকেন্দ্র। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘বিশ্বে পূর্ণতাপ্রাপ্ত মহিলা হলেন চারজন। ফেরাঊনের স্ত্রী আসিয়া, ইমরানের কন্যা মারিয়াম, খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ ও তার কন্যা ফাতিমাতুয যাহরা (রাঃ)। তিনি ছিলেন সেই মহীয়সী মহিলা যাকে আল্লাহ পাক জিব্রীল মারফত সালাম পাঠান এবং জান্নাতে তার জন্য বিশেষভাবে নির্মিত মতিমহলের সুসংবাদ দেন।
তিনিই একমাত্র স্ত্রী যার জীবদ্দশায় রাসূল (সাঃ) অন্য কোন স্ত্রী গ্রহণ করেননি এবং তার মৃত্যুর পরেও আজীবন রাসূল (সাঃ) তাকে বারবার স্মরণ করেছেন। অন্য স্ত্রীদের সামনে অকুণ্ঠচিত্তে তার প্রশংসা করেছেন। এমনকি তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে খাদীজার বান্ধবীদের কাছেও উপঢৌকন পাঠাতেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে চাচা ও খাদীজার মৃত্যু হওয়ার কারণে আল্লাহর রাসূল এই বছরকে عام الحزن বা দুঃখের বছর বলে অভিহিত করেন।
সওদার সাথে বিবাহ:
খাদীজা (রাঃ)-এর মৃত্যুর পর বিপর্যস্ত সংসারের হাল ধরার জন্য এবং মাতৃহারা কন্যাদের দেখাশুনার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাওদাহ বিনতে যাম‘আহ নাম্নী জনৈকা বিধবা মহিলাকে বিবাহ করেন ১০ম নববী বর্ষের শাওয়াল মাসে।
ত্বায়েফ গমন (শাওয়াল ১০ম নববী বর্ষ):
খাদীজার মৃত্যুর পরবর্তী মাসে অর্থাৎ দশম নববী বর্ষের শাওয়াল মাস মোতাবেক ৬১৯ খৃষ্টাব্দের গ্রীষ্মকালে মে মাসের শেষে অথবা জুন মাসের প্রথমে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বীয় মুক্তদাস যায়েদ বিন হারেছাহকে সাথে নিয়ে প্রধানতঃ নতুন সাহায্যকারীর সন্ধানে পদব্রজে ত্বায়েফ রওয়ানা হন। যা ছিল মক্কা হ’তে প্রায় ষাট মাইল দূরে।
অতঃপর ত্বায়েফ পৌঁছে তিনি সেখানকার বনু ছাক্বীফ গোত্রের তিন নেতা তিন সহোদর ভাই ইবনু আব্দে ইয়ালীল, মাসঊদ ও হাবীব-এর সাথে সাক্ষাত করেন এবং তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দেন। সাথে সাথে ইসলামকে সাহায্য করার জন্য তিনি তাদের প্রতি আহবান জানান। উক্ত তিনভাইয়ের একজনের কাছে কুরায়েশ গোত্র বনু জুমাহ (بنو جمح) -এর একজন মহিলা বিবাহিতা ছিলেন (ইবনু হিশাম)। সেই আত্মীয়তার সূত্র ধরেই রাসূল (সাঃ) সেখানে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনজনই তাঁকে নিরাশ করল।
একজন বলল, সে কা‘বার গোলাফ ছিঁড়ে ফেলবে, যদি আল্লাহ তোমাকে রাসূল করে পাঠিয়ে থাকেন’।
অন্যজন বলল, ‘আল্লাহ কি তোমাকে ব্যতীত অন্য কাউকে পাননি’? ‘যার একটা সওয়ারী পর্যন্ত নেই! যদি কাউকে রাসূল বানানোর দরকার হত, তাহলে তো আল্লাহ কোন শাসক বা নেতাকে রাসূল করে পাঠাতে পারতেন’।
তৃতীয় জন বলল,‘আমি তোমার সাথে কোন কথাই বলব না। কেননা যদি তুমি সত্যিকারের নবী হও, তবে তোমার কথা প্রত্যাখ্যান করা আমার জন্য হবে সবচেয়ে বিপজ্জনক। আর যদি তুমি আল্লাহর নামে মিথ্যা প্রচারে লিপ্ত হয়ে থাক, তবে তোমার সাথে কথা বলা সমীচীন নয়।
নেতাদের কাছ থেকে নিরাশ হয়ে এবার তিনি অন্যদের কাছে দাওয়াত দিতে থাকেন। কিন্তু সবার একই কথা ‘তুমি আমাদের শহর থেকে বেরিয়ে যাও’। অবশেষে দশদিন পর তিনি সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের জন্য পা বাড়ান। এমন সময় নেতাদের উস্কানীতে একদল ছোকরা এসে তাঁকে ঘিরে ধরে অশ্রাব্য ভাষায় গালি-গালাজ ও হৈ চৈ শুরু করে দিল। এক পর্যায়ে তাঁকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়তে আরম্ভ করল।
যাতে তাঁর পায়ের গোড়ালী ফেটে রক্তে জুতা ভরে গেল’। এ সময় যায়েদ বিন হারেছাহ ঢালের মত থেকে রাসূলকে প্রস্তরবৃষ্টি থেকে রক্ষার চেষ্টা করেন। এইভাবে রক্তাক্ত দেহে তিন মাইল হেঁটে তায়েফ শহরের বাইরে এক আঙ্গুর বাগিচায় ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় তিনি আশ্রয় নেন। তখন ছোকরার দল ফিরে যায়।
মযলূমের দোআ:
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বাগানে প্রবেশ করে আঙ্গুর গাছের ছায়ায় একটি দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পড়লেন। এই সময় ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহ নিয়ে ব্যাকুল মনে আল্লাহর নিকটে যে দোআ তিনি করেছিলেন, তা (মযলূমের দোআ হিসাবে) ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। দো‘আটি ছিল নিম্নরূপ:
‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকটে আমার শক্তির দুর্বলতা, কৌশলের স্বল্পতা ও মানুষের নিকটে অপদস্থ হওয়ার অভিযোগ পেশ করছি- হে দয়ালুগণের সেরা! হে দুর্বলদের প্রতিপালক! তুমিই আমার একমাত্র পালনকর্তা। কাদের কাছে তুমি আমাকে সোপর্দ করেছ? তুমি কি আমাকে এমন দূর অনাত্মীয়ের কাছে পাঠিয়েছ যে আমাকে কষ্ট দেয়? অথবা এমন শত্রুর কাছে যাকে তুমি আমার কাজের মালিক-মুখতার বানিয়ে দিয়েছ? য
দি আমার উপরে তোমার কোন ক্রোধ না থাকে, তাহলে আমি কোন কিছুরই পরোয়া করি না। কিন্তু তোমার ক্ষমা আমার জন্য অনেক প্রশস্ত। আমি তোমার চেহারার জ্যোতির আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যার জন্য সব অন্ধকার আলোকিত হয়ে যায় এবং দুনিয়া ও আখেরাতের কর্মসমূহ সুষ্ঠু হয়ে যায়- এই বিষয় হতে যে, আমার উপরে তোমার গযব নাযিল হৌক অথবা তোমার ক্রোধ আপতিত হৌক। কেবল তোমারই সন্তুষ্টি কামনা করব, যতক্ষণ না তুমি খুশী হও। নেই কোন শক্তি নেই কোন ক্ষমতা তুমি ব্যতীত।
আঙ্গুর বাগানের মালিক দু’ভাই ওৎবা ও শায়বা যখন দূর থেকে রাসূলের এ দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা দেখল, তখন তারা দয়াপরবশ হয়ে তাদের খৃষ্টান গোলাম ‘আদ্দাস’-এর মাধ্যমে এক গোছা আঙ্গুর পাঠিয়ে দিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ‘বিসমিল্লাহ’ বলে তা হাতে নিয়ে খেতে আরম্ভ করলেন। বিস্মিত হয়ে আদাস বলে উঠল, এ ধরনের কথা তো এ অঞ্চলের লোকদের মুখে কখনো শুনিনি’? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তুমি কোন দেশের লোক?
তোমার ধর্ম কি? সে বলল, আমি একজন খৃষ্টান। আমি ‘নীনাওয়া’-এর বাসিন্দা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, নেককার ব্যক্তি ইউনুস বিন মাত্তা -এর জনপদের লোক? লোকটি আশ্চর্য হয়ে বলল, আপনি ইউনুস বিন মাত্তা-কে কিভাবে চিনলেন? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘তিনি আমার ভাই। তিনি নবী ছিলেন এবং আমিও নবী।
ত্বায়েফ হ’তে মক্কার পথে:
কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ব্যথিত ও ভারাক্রান্ত মনে সেখান থেকে উঠে মক্কাভিমুখে রওয়ানা হলেন। পথিমধ্যে ‘ক্বারনুল মানাযিল’ নামক স্থানে পৌঁছলে জিব্রীল (আঃ) ‘মালাকুল জিবাল’ বা পাহাড় সমূহের নিয়ন্ত্রক ফেরেশতাকে সাথে নিয়ে অবতীর্ণ হলেন। জিব্রীল তাঁকে বললেন, ‘আপনার সম্প্রদায় আপনাকে কি কথা বলেছে এবং আপনার প্রতি কিরূপ আচরণ করেছে, সবই আল্লাহ দেখেছেন ও শুনেছেন। এক্ষণে তিনি আপনার নিকটে পাহাড় সমূহের নিয়ন্ত্রক ফেরেশতাকে পাঠিয়েছেন তাকে আপনি তাদের বিষয়ে যা ইচ্ছা হুকুম করুন’।
অতঃপর ‘মালাকুল জিবাল’ এসে রাসূলকে সালাম দিয়ে বলল, ‘যদি আপনি চান যে, আমি দুই পাহাড়কে একত্রিত করে এদেরকে পিষে মারি, তাহলে আমি তাই-ই করব’। ফেরেশতার জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘না। বরং আমি আশা করি যে, আল্লাহ তাদের পৃষ্ঠদেশ হতে এমন বংশধর সৃষ্টি করবেন, যারা কেবলমাত্র মহান আল্লাহরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না’।
এই ঘটনায় আল্লাহর নবী (সাঃ) হৃদয়ে প্রশান্তি অনুভব করলেন এবং সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে গিয়ে পুনরায় পথ চলতে শুরু করলেন। অতঃপর ‘নাখ্লা’ উপত্যকায় পৌঁছে সেখানকার জনপদে কয়েকদিন অবস্থান করলেন। এখানেই জিনদের ইসলাম গ্রহণের ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে।
যা সূরা আহক্বাফ ২৯, ৩০ ও ৩১ আয়াতে এবং সূরা জিন ১-১৫ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। এতে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মনের মধ্যে আরও শক্তি অনুভব করেন। তিনি নিশ্চিত হ’লেন যে, কোন শক্তিই তার দাওয়াতকে বন্ধ করতে পারবে না। কেননা আহক্বাফ ৩২ আয়াত নাযিল করে এ সময়েই আল্লাহ তাকে নিশ্চিত করেছিলেন যে,
وَمَن لاَّ يُجِبْ دَاعِيَ اللهِ فَلَيْسَ بِمُع ْجِزٍ فِي الْأَرْضِ وَلَيْسَ لَهُ مِنْ دُوْنِهِ أَوْلِيَاءَ أُوْلَئِكَ فِيْ ضَلاَلٍ مُّبِيْنٍ-
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে আহবানকারীর ডাকে সাড়া না দেয়, সে ব্যক্তি এ পৃথিবীতে আল্লাহকে পরাজিত করতে পারবে না এবং আল্লাহ ব্যতীত সে কাউকে সাহায্যকারীও পাবে না। বস্ত্ততঃ এলোকগুলিই হল স্পষ্ট ভ্রষ্টতার মধ্যে নিপতিত’ (আহক্বাফ ৪৬/৩২)।
উপরোক্ত ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, শেষনবী (সাঃ) জিন ও ইনসানের নবী ছিলেন। বরং তিনি সকল সৃষ্ট জীবের নবী ছিলেন। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, و أرسلتُ إلى الخلق كافة و خُتِمَ بِىَ الن بيُّون- ‘আমি সকল সৃষ্ট জীবের প্রতি প্রেরিত হয়েছি এবং আমাকে দিয়ে নবীদের সিলসিলা সমাপ্ত করা হয়েছে’।
মক্কায় প্রত্যাবর্তন:
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নাখলা উপত্যকা হতে মক্কাভিমুখে রওয়ানা করে হেরা গুহার পাদদেশে পৌঁছে মক্কায় প্রবেশের জন্য সম্ভাব্য কিছু হিতাকাংখীর নিকটে খবর পাঠালেন। কিন্তু কেউ ঝুঁকি নিতে চায়নি। অবশেষে মুত্ব‘ইম বিন ‘আদী রাযী হন এবং তার সম্মতিক্রমে যায়েদ বিন হারেছাহকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কায় এসে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন ও হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করেন।
অতঃপর দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করেন। এ সময় মুত্ব‘ইম ও তার পুত্র সশস্ত্র অবস্থায় তাঁকে পাহারা দেয় এবং পরে তাঁকে বাড়ীতে পৌঁছে দেয়। আবু জাহল মুত্ব‘ইমকে প্রশ্ন করল ‘তুমি কি তাকে আশ্রয় দিয়েছ না, অনুসারী মুসলিম হয়ে গেছ’? মুত্ব‘ইম জবাবে বলেন, ‘আশ্রয় দিয়েছি মাত্র’। তখন আবু জাহল বলে উঠল, আমরাও তাকে আশ্রয় দিলাম, যাকে তুমি আশ্রয় দিয়েছ’।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুত্ব‘ইম বিন আদীর এই সৌজন্যের কথা কখনো ভুলেননি। এই ঘটনার প্রায় পাঁচ বছর পরে সংঘটিত বদরের যুদ্ধে বন্দী কাফেরদের মুক্তির ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘যদি মুত্ব‘ইম বিন আদী বেঁচে থাকত এবং এইসব দুর্গন্ধময় মানুষগুলোর জন্য সুফারিশ করত, তাহলে তার খাতিরে আমি এদের সবাইকে ছেড়ে দিতাম’।
হামযা ও ওমর (রাঃ) এর ইসলাম গ্রহণ এবং তার পরবর্তী ঘটনা
হামযার ইসলাম গ্রহণ (৬ষ্ঠ নববী বর্ষের শেষ দিকে):
৬ষ্ঠ নববী বর্ষের শেষ দিকে যিলহাজ্জ মাসের কোন এক দিনে ছাফা পাহাড়ের পাশ দিয়ে যাবার সময় আবু জাহল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে প্রথমে অশ্লীল ভাষায় গালি-গালাজ করল। তাতে তাঁর কোন ভাবান্তর দেখতে না পেয়ে আবু জাহল একটা পাথর ছুঁড়ে রাসূলের মাথায় আঘাত করল।
তাতে তাঁর মাথা ফেটে রক্ত ধারা প্রবাহিত হতে থাকল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নীরবে সবকিছু সহ্য করলেন। আবু জাহল অতঃপর কা‘বা গৃহের নিকটে গিয়ে তার দলবলের সাথে বসে উক্ত কাজের জন্য গৌরব যাহির করতে থাকল।
আব্দুল্লাহ বিন জুদ‘আনের জনৈক দাসী ছাফা পাহাড়ের উপরে তার বাসা থেকে এ দৃশ্য অবলোকন করে। ঐ সময় হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব মৃগয়া থেকে তীর-ধনুকে সুসজ্জিত অবস্থায় ঘরে ফিরছিলেন। তখন উক্ত দাসীর নিকটে সব ঘটনা শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ছুটলেন আবু জাহলের খোঁজে। তিনি ছিলেন কুরায়েশগণের মধ্যে মহাবীর ও শক্তিশালী যুবক। তিনি গিয়ে আবু জাহলকে মাসজিদুল হারামে পেলেন এবং তীব্র ভাষায় তাকে গালি দিয়ে বললেন,
‘হে গুহ্যদ্বার দিয়ে বায়ু নিঃসরণকারী (অর্থাৎ হে কাপুরুষ)! তুমি আমার ভাতিজাকে গালি দিয়েছ, অথচ আমি তার দ্বীনের উপরে আছি’? বলেই তার মাথায় ধনুক দিয়ে এমন জোরে আঘাত করলেন যে, সে দারুণভাবে যখম হয়ে রক্তাক্ত হয়ে গেল। তখন আবু জাহলের বনু মাখযূম গোত্র এবং হামযার বনু হাশেম গোত্র পরস্পরের বিরুদ্ধে চড়াও হল। এমতাবস্থায় আবু জাহল নিজের দোষ স্বীকার করে নিজ গোত্রকে নিরস্ত করল
। ফলে আসন্ন খুনোখুনি হতে উভয় পক্ষ বেঁচে গেল। বলা বাহুল্য, হামযার এই ইসলাম কবুলের ঘোষণাটি ছিল আকস্মিক এবং ভাতিজার প্রতি ভালোবাসার টানে। পরে আল্লাহ তার অন্তরকে ইসলামের জন্য প্রশস্ত করে দেন এবং তিনি নির্যাতিত মুসলমানদের জন্য শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য স্তম্ভরূপে আবির্ভূত হন।
ওমরের ইসলাম গ্রহণ:
হামযার ইসলাম গ্রহণের মাত্র তিন দিন পরেই আল্লাহর অপার অনুগ্রহে আরেকজন কুরায়েশ বীর ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব আকস্মিকভাবে মুসলমান হয়ে যান। অবশ্য এটি ছিল রাসূলের বিশেষ দোআর ফসল। কেননা তিনি খাছভাবে দো‘আ করেছিলেন যে, ‘হে আল্লাহ! ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব অথবা আমর ইবনু হেশাম (আবু জাহল) এই দুজনের মধ্যে তোমার নিকটে যিনি অধিকতর প্রিয় তার মাধ্যমে তুমি ইসলামকে শক্তিশালী কর। পরের দিন সকালে তিনি এসে ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং কা‘বা গৃহে গিয়ে প্রকাশ্যে ছালাত আদায় করলেন।
অতঃপর ওমরের ইসলাম গ্রহণের ফলে প্রমাণিত হল যে, তিনিই ছিলেন আল্লাহর নিকটে অধিকতর প্রিয়। ওমর ছিলেন অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির মানুষ এবং পিতৃধর্মের প্রতি অন্ধ আবেগ পোষণকারী। একই কারণে তিনি ছিলেন ইসলামের একজন বিপজ্জনক শত্রু। সে কারণেই একদিন তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তরবারি নিয়ে রওয়ানা হলেন। পথিমধ্যে নু‘আইম বিন আব্দুল্লাহ্র সঙ্গে দেখা হল, যিনি তার ইসলাম গোপন রেখেছিলেন। তিনি বলেন, কোথায় চলেছ ওমর? তিনি বললেন, ‘আমি এই বিধর্মী মুহাম্মাদের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছি।
এ ব্যক্তি কুরায়েশদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করেছে, তাদের জ্ঞানীদের বোকা বলেছে, তাদের ধর্মে দোষারোপ করেছে, তাদের উপাস্যদের গালি দিয়েছে। অতএব আমি তাকে হত্যা করব’। নু‘আইম বললেন, তাকে হত্যা করে বনু হাশেম ও বনু যোহরা থেকে কিভাবে রক্ষা পাবে? ওমর বললেন, তুমিও দেখছি পূর্ব পুরুষের ধর্ম পরিত্যাগ করে বেদ্বীন হয়ে গেছ’? নু‘আইম বললেন, আমি কি তোমাকে একটি আশ্চর্যজনক খবর দেব না? ওমর বললেন, কি খবর? নু‘আইম বলল, ‘তোমার বোন ও ভগ্নিপতি বেদ্বীন হয়ে গেছে এবং তারা তোমার ধর্ম পরিত্যাগ করেছে’।
এতে ওমরের আত্মসম্মানে ঘা লাগলো এবং ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বোনের বাড়ীর দিকে ছুটলেন। হযরত খাববাব ইবনুল আরত ঐসময় ঘরের মধ্যে গোপনে স্বামী-স্ত্রীকে কুরআনের সূরা ত্বোয়াহা-এর তা‘লীম দিচ্ছিলেন। ওমরের পদশব্দে হতচকিত হয়ে তিনি ঘরের এক কোণে লুকিয়ে যান। ওমর ঘরে ঢুকে বললেন, শুনলাম তোমরা দু’জনে বেদ্বীন হয়ে গেছ? ভগ্নিপতি সাঈদ বললেন, ‘হে ওমর! যদি আপনার ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মে সত্য নিহিত থাকে, তবে সেবিষয়ে আপনার রায় কি’? একথা শুনে ওমর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে ভগ্নিপতির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ও তাকে নির্মমভাবে প্রহার করতে থাকলেন। তখন বোন (ফাতেমা) তাকে স্বামী থেকে পৃথক করে দিলেন।
এতে ওমর ক্ষিপ্ত হয়ে বোনের গালে জোরে চপেটাঘাত করলেন। তাতে বোনের মুখমন্ডল রক্তাক্ত হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বোন তেজস্বী কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘হে ওমর! তোমার ধর্ম ছাড়া যদি অন্য ধর্মে সত্য থাকে? বলেই তিনি সোচ্চার কণ্ঠে কলেমায়ে শাহাদাত উচ্চারণ করলেন (আর-রাহীক্ব) এবং বললেন, ‘আমরা ইসলাম কবুল করেছি এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর ঈমান এনেছি। এক্ষণে তোমার যা খুশী কর’ (ইবনু হিশাম)। বোনের রক্তাক্ত চেহারা দেখে এবং তার মুখে এ দৃপ্ত সাক্ষ্য শুনে ওমরের মধ্যে ভাবান্তর দেখা দিল।
তিনি লজ্জিত হলেন ও দয়ার্দ্র কণ্ঠে বললেন, তোমাদের কাছে যে পুস্তিকাটা আছে, ওটা আমাকে একটু পড়তে দাও’। বোন সরোষে বললেন, তুমি অপবিত্র। ঐ কিতাব পবিত্র ব্যক্তি ভিন্ন স্পর্শ করতে পারে না। ওঠ, গোসল করে এসো। ওমর তাই করলেন। অতঃপর কুরআনের উক্ত খন্ডটি হাতে নিয়ে সূরা ত্বোয়াহা পড়তে শুরু করলেন। যখন ১৪তম আয়াত পাঠ করলেন
إِنَّنِي أَنَا اللهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلاَةَ لِذِكْرِي-
‘নিশ্চয়ই আমিই আল্লাহ, আমি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। অতএব তুমি আমারই ইবাদত কর এবং আমার স্মরণে ছালাত কায়েম কর’ (ত্বোয়াহা ২০/১৪)।
এ আয়াত পাঠ করেই ওমর বলে উঠলেন, ‘কতই না সুন্দর ও কতই না মর্যাদাপূর্ণ এ বাণী? তোমরা আমাকে মুহাম্মাদ কোথায় বাৎলে দাও! ওমরের একথা শুনে খাববাব গোপন স্থান থেকে ত্বরিৎ বেরিয়ে এসে বললেন, ‘সুসংবাদ গ্রহণ কর হে ওমর! আমি আশা করি গত বৃহস্পতিবার রাতে আল্লাহর রাসূল যে দো‘আ করেছিলেন তা তোমার শানে কবুল হয়েছে’। চল আল্লাহর রাসূল ছাফা পাহাড়ের পাদদেশের বাড়ীতে অবস্থান করছেন। যথাসময়ে কোষবদ্ধ তরবারি সহ ওমর সেখানে উপস্থিত হলেন।
তাঁকে তরবারিসহ দেখে হামযা (রাঃ)-এর নেতৃত্বে সবাই তাকে মোকাবিলার জন্য প্রস্ত্তত হয়ে গেলেন। হামযা সবাইকে আশ্বস্ত করে বললেন, তাকে স্বাচ্ছন্দে আসতে দাও। যদি সে সদিচ্ছা নিয়ে এসে থাকে তবে ভাল। নইলে তরবারি দিয়েই তার ফায়ছালা করা হবে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে ওমরের জামার কলার ও তরবারির খাপ ধরে জোরে টান দিয়ে বললেন, অলীদ বিন মুগীরাহ্র মত অপদস্থ ও শাস্তিপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কি তুমি বিরত হবে না’? অতঃপর আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করে বললেন, ‘হে আল্লাহ! এই যে ওমর! হে আল্লাহ তুমি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাবের মাধ্যমে ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি কর’।
এই দো‘আর প্রভাব ওমরের উপরে এমনভাবে পড়ে যে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং আপনি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল’। সাথে সাথে তিনি ইসলাম কবুল করলেন এবং আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ও গৃহবাসী ছাহাবীগণ এমন জোরে তাকবীর ধ্বনি করলেন যে, মসজিদুল হারাম পর্যন্ত সে আওয়ায পৌঁছে গেল’।
ওমরের ইসলাম পরবর্তী ঘটনা:
ইসলাম কবুলের পরপরই তিনি ইসলামের সবচেয়ে বড় দুশমন আবু জাহলের গৃহে গমন করলেন এবং তার মুখের উপরে বলে দিলেন যে, ‘আমি তোমার কাছে এসেছি এ খবর দেওয়ার জন্য যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদের উপরে ঈমান এনেছি এবং তিনি যে শরী‘আত এনেছেন, আমি তা সত্য বলে জেনেছি’। একথা শুনেই আবু জাহল সরোষে তাকে গালি দিয়ে বলে উঠল ‘আল্লাহ তোমার মন্দ করুন এবং তুমি যে খবর নিয়ে এসেছ, তার মন্দ করুন’। অতঃপর তার মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে ভিতরে চলে গেল।
এরপর ওমর গেলেন সে সময়ের সেরা মাউথ মিডিয়া জামীল বিন মা‘মার আল-জামহীর কাছে এবং তাকে বললেন যে, আমি মুসলমান হয়ে গেছি’। সে ছিল কুরায়েশ বংশের সেরা ঘোষক এবং অত্যন্ত উচ্চ কণ্ঠের অধিকারী। গুরুত্বপূর্ণ কোন সংবাদ তার মাধ্যমেই সর্বত্র প্রচার করা হত। ওমর (রাঃ)-এর মুখ থেকে তাঁর ইসলাম গ্রহণের সংবাদ শোনামাত্র সে বেরিয়ে পড়ল। আর চিৎকার দিয়ে সবাইকে শুনাতে থাকল, ‘খাত্বাবের বেটা বিধর্মী হয়ে গেছে’। ওমর (রাঃ) তার পিছনেই ছিলেন। তিনি বললেন, ‘সে মিথ্যা বলছে। বরং আমি মুসলমান হয়েছি’।
একথা শোনা মাত্র চারিদিক থেকে লোক জমা হয়ে গেল এবং সকলে ওমরের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে গণপিটুনী শুরু করল। এই মারপিট দুপুর পর্যন্ত চলল। এই সময় কাফিরদের উদ্দেশ্যে ওমর বলেন, যদি আমরা সংখ্যায় তিনশ’ পুরুষ হতাম, তবে দেখতাম এরপরে মক্কায় তোমরা থাকতে, না আমরা থাকতাম’।
এই ঘটনার পর নেতারা ওমরকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার বাড়ী আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিল। ওমর (রাঃ) ঘরের মধ্যেই ছিলেন। এমন সময় তাদের গোত্রের সঙ্গে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ বনু সাহম গোত্রের জনৈক নেতা আছ ইবনে ওয়ায়েল সাহ্মী সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। ওমর (রাঃ) তাকে বললেন যে, আমি মুসলমান হয়েছি বিধায় আপনার সম্প্রদায় আমাকে হত্যা করতে চায়’।
তিনি বলে উঠলেন, ‘কখনোই তা হবার নয়’। বলেই তিনি সোজা চলে গেলেন জনতার ভিড়ের সামনে। জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এখানে জটলা করছ কেন? তারা বলল, ‘ইবনুল খাত্ত্বাব বিধর্মী হয়ে গেছে’। তিনি বললেন, ‘যাও! সেখানে যাবার কোন প্রয়োজন নেই’। তার একথা শুনে লোকেরা ফিরে গেল। এরপর ওমর (রাঃ) রাসূলের খিদমতে হাযির হয়ে বললেন,
‘হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি হক-এর উপরে নই? তিনি বললেন, হাঁ। যার হাতে আমার জীবন, তার কসম করে বলছি, নিশ্চয়ই তোমরা সত্যের উপরে আছ যদি তোমরা মৃত্যুবরণ কর কিংবা জীবিত থাক’। তখন ওমর বললেন, তাহলে লুকিয়ে থাকার কি প্রয়োজন? যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন তার কসম করে বলছি, অবশ্যই আমরা প্রকাশ্যে বের হব’। অতঃপর রাসূলকে মাঝখানে রেখে দুই সারির মাথায় ওমর ও হামযার নেতৃত্বে মুসলমানগণ প্রকাশ্যে মিছিল সহকারে মসজিদুল হারামে উপস্থিত হলেন। বনু হাশিম ও বনু মুত্ত্বালিব গোত্রের প্রতি আবু ত্বালিবের আহবান :
হামযা ও ওমর (রাঃ)-এর পরপর মুসলমান হয়ে যাওয়ায় কুরায়েশরা দারুণভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। ইতিপূর্বে তারা মুহাম্মাদকে হত্যা করে তার রক্তের বিনিময়ে জনৈক উমারাহ বিন ওয়ালীদ নামক এক যুবককে আবু তালিবের কাছে সমর্পণ করতে এসেছিল। ফলে হামযা ও ওমরের ইসলাম গ্রহণে মুসলমানদের মধ্যে আনন্দ ও সাহসের সঞ্চার হলেও দূরদর্শী ও স্নেহশীল চাচা আবু ত্বালিবের বুকটা ভয়ে সব সময় দুরু দুরু করত কখন কোন মুহূর্তে শয়তানেরা আকস্মিকভাবে মুহাম্মাদকে হামলা করে মেরে ফেলে।
দূরদর্শী ও স্নেহশীল চাচা আবু ত্বালিব সবদিক ভেবে একদিন স্বীয় প্রপিতামহ আবদে মানাফের দুই পুত্র হাশেম ও মুত্ত্বালিবের বংশধরগণকে একত্রিত করলেন। অতঃপর তাদের সামনে বললেন যে, এতদিন আমি এককভাবে ভাতিজা মুহাম্মাদের তত্ত্বাবধান করেছি। কিন্তু এখন এই চরম বার্ধক্যে ও প্রচন্ড বৈরী পরিবেশে আমার পক্ষে এককভাবে আর মুহাম্মাদের নিরাপত্তা বিধান করা সম্ভবপর নয়।
সেকারণ আমি আপনাদের সকলের সহযোগিতা চাই’। গোত্র নেতা আবু ত্বালিবের এই আহবানে ও গোত্রীয় রক্তধারার আকর্ষণে সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল এবং মুহাম্মাদের হেফাযতের ব্যাপারে সবাই একযোগে তাকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিল। একমাত্র চাচা আবু লাহাব বিরোধিতা করল এবং সে মুহাম্মাদের বিপক্ষ দলের প্রতি সমর্থন দানের ঘোষণা দিল।
বিরোধী পক্ষের পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ:
এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ঘটে যাওয়া পরপর চারটি ঘটনায় মুশরিক নেতাদের মধ্যে যেমন আতংক সৃষ্টি হয়, তেমনি মুহাম্মাদ ও তার সাথীদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। কারণগুলি ছিল যথাক্রমে-
(১) মুহাম্মাদকে প্রদত্ত লোভনীয় প্রস্তাব সমূহ নাকচ হওয়া। অতঃপর উভয় দলের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানাদির কিছু গ্রহণ ও কিছু বর্জনের আপোষ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হওয়া
(২) হামযার ইসলাম গ্রহণ ও সরাসরি আবু জাহলের উপরে হামলা করা
(৩) ওমরের ইসলাম গ্রহণ ও সরাসরি আবু জাহলের বাড়ীতে গিয়ে তার মুখের উপর তার ইসলাম গ্রহণের সংবাদ দেওয়া। অতঃপর মুসলমানদের মিছিল করে সর্বপ্রথম মসজিদুল হারামে আগমন ও প্রকাশ্যে ধর্মীয় বিধি-বিধান সমূহ পালন শুরু করা এবং
(৪) সবশেষে আবু তালিবের আহবানে সাড়া দিয়ে বনু হাশেম ও বনু মুত্ত্বালিবের মুসলিম-কাফির সকলের পক্ষ হতে মুহাম্মাদকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দানের অঙ্গীকার ঘোষণা করা। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে মুশরিক নেতৃবৃন্দ মুহাছছাব উপত্যকায় সমবেত হয় এবং বিস্তারিত আলোচনার পর বনু হাশেম ও বনু মুত্ত্বালিব গোত্রদ্বয়ের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বয়কটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
সর্বাত্মক বয়কট (৭ম নববী বর্ষের শুরুতে):
সিদ্ধান্ত মোতাবেক সকলে এই মর্মে প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে যে,
(১) বনু হাশেম ও বনু মুত্ত্বালিবের সাথে বিয়ে-শাদী বন্ধ থাকবে
(২) তাদের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ও যাবতীয় লেন-দেন বন্ধ থাকবে
(৩) তাদের সাথে উঠাবসা, মেলা-মেশা, কথাবার্তা ও তাদের বাড়ীতে যাতায়াত বন্ধ থাকবে- যতদিন না তারা মুহাম্মাদকে হত্যার জন্য তাদের হাতে তুলে দিবে। সপ্তম নববী বর্ষের ১লা মুহাররমের রাতে সম্পাদিত উক্ত অঙ্গীকারপত্রটি কা‘বা গৃহের ভিতরে টাঙিয়ে রাখা হল। উক্ত অঙ্গীকারনামার লেখক বুগায়েয (بغيض) বিন আমের বিন হাশেম-এর প্রতি আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বদ দো‘আ করেন। ফলে তার হাতটি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়।
শে‘আবে আবু ত্বালিবে তিন বছর:
উপরোক্ত অন্যায় চুক্তি সম্পাদনের ফলে বনু হাশেম ও বনু মুত্ত্বালিব উভয় গোত্রের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নিদারুণ কষ্টের সম্মুখীন হল। সঞ্চিত খাদ্যশস্য ফুরিয়ে গেলে তাদের অবস্থা চরমে ওঠে। ফলে তারা গাছের ছাল-পাতা খেয়ে জীবন ধারণে বাধ্য হন। নারী ও শিশুরা ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করত। তাদের ক্রন্দন ধ্বনি গিরি-সংকটের বাইরের লোকেরা শুনতে পেত। ফলে কেউ কেউ অতি সংগোপনে তাদের কাছে খাদ্য পৌঁছাতো। একবার হাকীম বিন হেযাম স্বীয় ফুফু খাদীজা (রাঃ)-এর নিকটে গম পৌঁছাতে গিয়ে আবু জাহলের হাতে ধরা পড়ে যান।
কিন্তু আবুল বুখতারীর হস্তক্ষেপে অবশেষে সমর্থ হন। হারামের চার মাস ব্যতীত অবরুদ্ধ গোত্রদ্বয়ের লোকেরা বের হতে পারতেন না। অবশ্য যেসব কাফেলা বাহির থেকে মক্কায় আসত, তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য-শস্য ক্রয়ে বাধা ছিল না। কিন্তু সেক্ষেত্রেও মক্কার ব্যবসায়ীরা জিনিষপত্রের এমন চড়ামূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল যে, তা ক্রয় করা প্রায় অসম্ভব ছিল। অন্যদিকে আবু তালিবের দুশ্চিন্তা ছিল রাসূলের জীবন নিয়ে।
রাতের বেলা সকলে শুয়ে যাওয়ার পর তিনি রাসূলকে উঠিয়ে এনে তার বিশ্বস্ত নিকটাত্মীয়দের সাথে বিছানা বদল করাতেন। যাতে কেউ তাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ না পায়। উক্ত কঠোর অবরোধ চলাকালীন সময়েও হজ্জের মওসুমে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বহির্দেশ থেকে আগত কাফেলা সমূহের তাঁবুতে গিয়ে তাওহীদের দাওয়াত দিতেন। ওদিকে আবু লাহাব তাঁর পিছে পিছে গিয়ে লোকদেরকে তাঁর কথা না শোনার জন্য বলত।
অঙ্গীকারনামা ছিন্ন ও বয়কটের সমাপ্তি:
প্রায় তিন বছর পূর্ণ হতে চলল। ইতিমধ্যে মুশরিকদের মধ্যে অসন্তোষ ও দ্বিধাবিভক্তি প্রকাশ্য রূপ নিল। যারা এই অন্যায় চুক্তিনামার বিরোধী ছিল, তারা ক্রমেই সংগঠিত হ’তে থাকল। বনু আমের বিন লুওয়াই গোত্রের হেশাম বিন আমরের উদ্যোগে যোহায়ের বিন আবী উমাইয়া ও মুত্ব‘ইম বিন ‘আদীসহ পাঁচজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ‘হাজূন’ নামক স্থানে বসে এ ব্যাপারে একমত হন এবং তাঁদের পক্ষে যোহায়ের কা‘বা গৃহ তাওয়াফ শেষে প্রথম সরাসরি আবু জাহলের মুখের উপরে উক্ত চুক্তিনামা ছিঁড়ে ফেলার হুমকি দেন। সাথে সাথে বাকী চারজন পরপর তাকে সমর্থন দেন। আবু জাহল বলল, বুঝেছি। তোমরা রাতের বেলা অন্যত্র পরামর্শ করেই এসেছ’।
ঐ সময়ে আবু ত্বালিব কা‘বা চত্বরে হাযির হলেন। তিনি কুরায়েশ নেতাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আল্লাহ তাঁর রাসূলকে তোমাদের চুক্তিনামা সম্পর্কে অবহিত করেছেন যে, ‘আল্লাহ ঐ অঙ্গীকারপত্রের উপরে কিছু কীট প্রেরণ করেছেন’। ‘অতঃপর তারা এর মধ্যকার যাবতীয় অন্যায়, বয়কট ও অত্যাচারমূলক কথাগুলো খেয়ে ফেলেছে, কেবল আল্লাহর নামগুলি ব্যতীত’।
অতঃপর আবু তবালেব নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘যদি তাঁর কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তাহলে তোমাদের ও তার মধ্য থেকে আমরা সরে দাঁড়াব। আর যদি তার কথা সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে তোমরা আমাদের প্রতি বয়কট ও যুলুম থেকে ফিরে যাবে’। আবু ত্বালিবের এ সুন্দর প্রস্তাবে সকলে সমস্বরে বলে উঠল ‘আপনি ইনছাফের কথাই বলেছেন’।
ওদিকে আবু জাহল ও মুত্ব‘ইম এবং অন্যান্যদের মধ্যে বাকযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে মুত্ব‘ইম বিন আদী কা‘বা গৃহে প্রবেশ করে অঙ্গীকারনামাটি ছিঁড়ে ফেলার উদ্দেশ্যে বাইরে নিয়ে এলেন। দেখা গেল যে, সত্য সত্যই তার সব লেখাই পোকায় খেয়ে ফেলেছে কেবলমাত্র ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’ (‘আল্লাহ তোমার নামে শুরু করছি’) বাক্যটি এবং অন্যান্য স্থানের আল্লাহর নামগুলি ব্যতীত।
এভাবে আবু ত্বালিবের মাধ্যমে প্রেরিত রাসূলের প্রাপ্ত অহীর সংবাদ সত্যে পরিণত হল। কুরায়েশ নেতারা অবাক বিস্ময়ে তা অবলোকন করল। অতঃপর অঙ্গীকার নামাটি মুত্ব‘ইম সর্বসমক্ষে ছিঁড়ে ফেললেন এবং এভাবে যথারীতি বয়কটের অবসান ঘটল ঠিক তিন বছরের মাথায় ১০ম নববী বর্ষের মুহাররম মাসে।
হাবশায় হিজরত এবং আবু তালিবের নিকটে কুরায়েশ নেতাদের আগমন
হাবশায় প্রথম হিজরত (রজব ৫ম বর্ষ):
চতুর্থ নববী বর্ষের মাঝামাঝি থেকে মুসলমানদের উপরে যে নির্যাতন শুরু হয় ৫ম নববী বর্ষের মাঝামাঝি নাগাদ তা চরম আকার ধারণ করে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই মযলূম মুসলমানদের রক্ষার জন্য উপায় খুঁজতে লাগলেন। তিনি অনেক আগে থেকেই পার্শ্ববর্তী হাবশার ন্যায়নিষ্ঠ খৃষ্টান রাজা আছহামা নাজ্জাশী (أصحمة النجاشى) -র প্রশংসা শুনে আসছিলেন যে, তার রাজ্যে মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করে।
সেমতে নবুঅতের পঞ্চম বর্ষের রজব মাসে হযরত ওছমান (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ১২ জন পুরুষ ও ৪ জন মহিলার প্রথম দলটি রাতের অন্ধকারে অতি সঙ্গোপনে হাবশার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যায়। এই দলে রাসূলের কন্যা ‘রুক্বাইয়া’ ছিলেন। রাসূল (সাঃ) বলেন,
‘তারা দু’জন ছিল ইবরাহীম ও লূত্ব-এর পরে আল্লাহর রাস্তায় হিজরতকারী প্রথম দল’।
হাবশায় ২য় হিজরত (সম্ভবত : যুলক্বা‘দাহ ৫ম বর্ষ):
হাবশার বাদশাহ কর্তৃক সদ্ব্যবহারের খবর শুনে কুরায়েশ নেতারা মুসলমানদের উপরে যুলুমের মাত্রা বাড়িয়ে দিল এবং কেউ যাতে আর হাবশায় যেতে না পারে, সেদিকে কড়া নযর রাখতে লাগল। কারণ এর ফলে তাদের দুটি ক্ষতি ছিল।
এক. বিদেশের মাটিতে কুরায়েশ নেতাদের যুলুমের খবর পৌঁছে গেলে তাদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হবে।
দুই. সেখানে গিয়ে মুসলমানেরা সংঘবদ্ধ হয়ে শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ পাবে। যাই হোক তাদের অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি এবং কড়া নযরদারী সত্তেবও ৮২ বা ৮৩ জন পুরুষ এবং ১৮ বা ১৯ জন মহিলা দ্বিতীয়বারের মত হাবশায় হিজরত করতে সমর্থ হন।
আবু তালিবের নিকটে কুরায়েশ নেতাদের আগমন (৬ষ্ঠ নববী বর্ষের মাঝামাঝি):
(১) কুরায়েশ নেতাগণ সম্মিলিতভাবে আবু তালিবের কাছে এলেন। এই দলে ছিলেন আবু সুফিয়ান ছাখর ইবনু হারব, ওৎবা ও শায়বাহ বিন রাবী‘আহ, আবু জাহল আমর ইবনু হেশাম (যিনি ‘আবুল হাকাম’ উপনামে পরিচিত ছিলেন), অলীদ বিন মুগীরাহ, নুবাইহ ও মুনাবিবহ বিন হাজ্জাজ ও ‘আছ বিন ওয়ায়েল এবং আরও কয়েকজন। তারা এসে বললেন, ‘আপনার ভাতিজা আমাদের উপাস্যদের গালি দিয়েছে, আমাদের দ্বীনকে দোষারোপ করেছে, আমাদের জ্ঞানীদের বোকা ঠাউরেছে এবং আমাদের বাপ-দাদাদের পথভ্রষ্ট মনে করেছে।’
এক্ষণে হয় আপনি তাকে বিরত রাখুন। অথবা আমাদের ও তার মাঝ থেকে সরে দাঁড়ান। কেননা আপনিও আমাদের ন্যায় তার আদর্শের বিরোধী। সেকারণ আমরা আপনাকে তার ব্যাপারে যথেষ্ট মনে করি’। ধৈর্য্যের সঙ্গে তাদের কথা শুনে আবু তালেব তাদেরকে নম্র ভাষায় বুঝিয়ে বিদায় করলেন।
২য় বার আগমন (৬ষ্ঠ নববী বর্ষ):
(২) মুসলমানদের সংখ্যা ক্রমে বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং নির্যাতনের ভয়ে সকলে পার্শ্ববতী খৃষ্টান রাজ্য হাবশায় গিয়ে আশ্রয় নেওয়ায় নেতারা প্রমাদ গুনলেন। অতঃপর বিদেশে তাদের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য এবং হিজরতকারীদের ফিরিয়ে আনার জন্য আমর ইবনুল আছ ও আবু জাহলের বৈপিত্রেয় সহোদর ভাই আবদুল্লাহ বিন রাবী‘আহকে নাজ্জাশীর দরবারে প্রেরণ করেন। কিন্তু তারা নিরাশ হয়ে ফিরে আসেন।
নেতারা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মুহাম্মাদের দাওয়াত ও প্রচারাভিযানকে একেবারেই বন্ধ করে দিতে পুনরায় আবু তালেবের কাছে এলেন এবং বললেন, আমাদের মধ্যে বয়সে, সম্মানে ও পদমর্যাদায় আপনি বিশেষ স্থানের অধিকারী। আমরা চেয়েছিলাম যে, আপনি আপনার ভাতিজাকে বিরত রাখবেন।
কিন্তু আপনি তাকে বিরত রাখেননি। আল্লাহর কসম! আমরা আর এ ব্যক্তির ব্যাপারে ধৈর্য রাখতে পারছি না। এক্ষণে হয় আপনি তাকে বিরত রাখুন, নয়তো আমরা তাকে ও আপনাকে এ ব্যাপারে একই পর্যায়ে নামাবো। যতক্ষণ না আমাদের দুপক্ষের একটি পক্ষ ধ্বংস হয়’। গোত্র নেতাদের এই চূড়ান্ত হুমকি শুনে আবু তালেব দুশ্চিন্তায় পড়লেন। অতঃপর রাসূলকে ডেকে এনে বললেন
‘হে আমার ভাতিজা! তোমার বংশের নেতারা আমার কাছে এসেছেন এবং এই এই কথা বলছেন।… অতএব তুমি আমার উপরে এমন বোঝা চাপিয়ো না, যা বহন করার ক্ষমতা আমার নেই’। চাচার এই কথা শুনে তিনি তাকে ছেড়ে যাচ্ছেন ধারণা করে সাময়িকভাবে বিহবল নবী আল্লাহর উপরে গভীর আস্থা রেখে বলে উঠলেন,
‘হে চাচা! যদি আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্র এনে দেওয়া হয় তাওহীদের এই প্রচার বন্ধ করার বিনিময়ে, আমি তা কখনোই পরিত্যাগ করব না। যতক্ষণ না আল্লাহ এই দাওয়াতকে বিজয়ী করেন অথবা আমি তাতে ধ্বংস হয়ে যাই’।
বলেই তিনি অশ্রুপূর্ণ নয়নে চলে যেতে উদ্যত হলেন। পরম স্নেহের ভাতিজার এই অসহায় দৃশ্য দেখে বয়োবৃদ্ধ চাচা তাকে পিছন থেকে ডাকলেন। তিনি তার দিকে মুখ তুলে তাকাতেই চাচা বলে উঠলেন, ‘যাও ভাতিজা! তুমি যা খুশী প্রচার কর। আল্লাহর কসম! কোন কিছুর বিনিময়ে আমি তোমাকে ওদের হাতে তুলে দেব না’।
আবু তালিবের এই কথা শুনে নেতারা বিফল মনোরথ হয়ে চলে গেলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খুশীতে বুক বাঁধলেন।
লোভনীয় প্রস্তাব:
শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মুহাম্মাদের দাওয়াত ও প্রচারাভিযানকে একেবারেই বন্ধ করে দিতেকঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে তারা রাসূলকে লোভ দেখানোর ফাঁদে আটকানোর চিন্তা করেন। সে মোতাবেক তারা মক্কার ধনীশ্রেষ্ঠ ওৎবা বিন রাবী‘আহকে সরাসরি রাসূলের কাছে কয়েকটি প্রস্তাব দিয়ে পাঠান। একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কা‘বা চত্বরে একাকী বসেছিলেন। তখন কুরায়েশ নেতাদের অনুমতি নিয়ে ওৎবা তাঁর কাছে গিয়ে বসলেন এবং বললেন, হে ভাতিজা! তোমার এই নতুন দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্য যদি সম্পদ উপার্জন হয়, তাহলে তুমি বললে আমরা তোমাকে আরবের সেরা ধনী বানিয়ে দেব।
আর যদি তোমার উদ্দেশ্য নেতৃত্ব লাভ হয়, তাহলে আমরা সবাই মিলে তোমাকে আমাদের নেতা বানিয়ে দেব। আর যদি আরবের বাদশাহ হতে চাও, তাহলে আমরা তোমাকে বাদশাহ বানিয়ে দেব। এমনকি তুমি যদি সুন্দরী স্ত্রী কামনা কর, তবে আমরা তোমার জন্য আরবের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী স্ত্রীর ব্যবস্থা করে দেব। আর যদি মনে কর, তোমার মাথার চিকিৎসা প্রয়োজন, তাহলে আমরাই তোমার জন্য সারা আরবের সেরা চিকিৎসককে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। আমাদের একটাই মাত্র দাবী, তুমি তোমার ঐ নতুন দ্বীনের দাওয়াত পরিত্যাগ কর।
জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, আমার সম্পর্কে আপনি যেসব কথা বললেন, এগুলির একটিও সত্য নয়। আমার মাল-ইযযত-হুকুমত, সুন্দরী স্ত্রী বা নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব কিছুই প্রয়োজন নেই। আমার মাথার চিকিৎসারও কোন প্রয়োজন নেই। আপনার প্রস্তাবসমূহের জওয়াবে আমি কেবল কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতগুলি পেশ করতে চাই।
অতঃপর তাকে তিনি ৫৪ আয়াত বিশিষ্ট সূরা ফুছছিলাত/হা-মীম সাজদাহ পাঠ করে শুনাতে লাগলেন। কুরআন শুনতে শুনতে ওৎবা মন্ত্রমুগ্ধের মত হয়ে গেলেন। এক বর্ণনায় এসেছে, যখন তিনি ১৩ তম আয়াত পাঠ করলেন, তখন ওৎবা ভয়ে রাসূলের মুখের উপরে হাত রেখে গযব নাযিলের ভয়ে বলে উঠলেন,
আল্লাহর দোহাই! তুমি তোমার সম্প্রদায়ের উপরে রহম কর’। অতঃপর ৩৮তম আয়াতের পর রাসূল সিজদা করলেন এবং উঠে বললেন, ‘আবুল ওয়ালীদ আপনি তো সবকিছু শুনলেন। এখন আপনার যা বিবেচনা হয় করুন’।
এরপর ওৎবা উঠে গেলেন। কুরায়েশ নেতারা সাগ্রহে ওৎবার কাছে জমা হলে তিনি বললেন, নেতারা শুনুন! আমি মুহাম্মাদের মুখ থেকে এমন বাণী শুনে এসেছি, যা কোন কাহিনী নয়, কবিতা নয় বা জাদুমন্ত্র নয়। সে এক অলৌকিক বাণী। আপনারা আমার কথা শুনুন! মুহাম্মাদকে বাধা দিবেন না। তাকে তার পথে ছেড়ে দিন’। লোকেরা হতবাক হয়ে বলে উঠলো ‘আল্লাহর কসম হে আবুল ওয়ালীদ! মুহাম্মাদ তার কথা দিয়ে তোমাকে জাদু করে ফেলেছে।’
পুনরায় আবু তালিব সমীপে নেতাগণ (৬ষ্ঠ নববী বর্ষে):
(৩) হুমকিতে ও লোভনীয় প্রস্তাবে কোন কাজ না হওয়ায় ক্ষুব্ধ নেতারা অল্প দিনের মধ্যে পুনরায় তার কাছে এক অভিনব প্রস্তাব নিয়ে গেলেন। তারা ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ এর পুত্র ওমারাহ-কে সাথে নিয়ে গেলেন এবং আবু তালিবকে বললেন, হে আবু তালিব! এই ছেলেটি হল কুরায়েশদের সবচেয়ে সুন্দর ও ধীমান যুবক। আপনি একে পুত্ররূপে গ্রহণ করুন এবং মুহাম্মাদকে আমাদের হাতে সোপর্দ করুন। কেননা
‘মুহাম্মাদ আপনার দ্বীন ও আপনার বাপ-দাদার দ্বীনের বিরোধিতা করেছে এবং আপনার সম্প্রদায়ের জামাআতী ঐক্য বিনষ্ট করেছে এবং তাদের জ্ঞানীদেরকে বোকা বলেছে। অতএব আমরা তাকে হত্যা করব’।
একজনের বদলে একজন হিসাবে এই ছেলেটিকে এনেছি মুহাম্মাদের বিনিময়ে আপনাকে দেবার জন্য।’ একথা শুনে ক্রুদ্ধ আবু তালেব রাগতঃস্বরে বলে উঠলেন,
‘আল্লাহর কসম! তোমরা কতবড় জঘন্য কথা আমাকে বলেছ। তোমরা তোমাদের ছেলেকে দিচ্ছ, যাতে আমি তাকে খাইয়ে-পরিয়ে মানুষ করি। আর আমার সন্তানকে তোমাদের হাতে তুলে দেব যাতে তোমরা তাকে হত্যা করতে পার? আল্লাহর কসম! তা কখনোই হবার নয়। …যাও তোমরা যা খুশী করতে পার’।
(৪) আবু তালেবের কাছ থেকে নিরাশ হওয়ার পর গোত্রনেতারা বসে আবু তালেবের গোত্র বনু হাশেম ও বনু আব্দুল মুত্ত্বালিবের সঙ্গে বয়কটের সিদ্ধান্ত নেন এবং ৭ম নববী বর্ষের ১লা মুহাররম হতে একটানা তিন বছর উক্ত বয়কট অব্যাহত থাকে। বয়কট শেষে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) পুনরায় স্বাভাবিকভাবে তাওহীদের দাওয়াত চালিয়ে যেতে থাকেন।
এ সময় একদিন যখন তিনি কা‘বা ত্বাওয়াফ করছিলেন, তখন অলীদ বিন মুগীরাহ, ‘আছ বিন ওয়ায়েল, আসওয়াদ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব, উমাইয়া ইবনে খালাফ প্রমুখ মক্কার বিশিষ্ট নেতৃবর্গ এসে সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে প্রস্তাব দেন ‘এসো আমরা ইবাদত করি, যার তুমি ইবাদত কর এবং তুমি ইবাদত কর, যার আমরা ইবাদত করি। তাতে আমরা ও তুমি আমাদের উপাসনার কাজে অংশীদার হব’।
যদি দেখা যায় যে, তোমার মা‘বূদ আমাদের মা‘বূদের চেয়ে উত্তম, তাহলে আমরা তার থেকে উত্তমটুকু গ্রহণ করব। আর যদি দেখা যায় যে, আমাদের মা‘বূদ তোমার মা‘বূদ থেকে উত্তম, তাহলে তুমি তার থেকে উত্তমটুকু গ্রহণ করবে’। তখন আল্লাহ সূরা কাফেরূণ নাযিল করেন।
শেষ বারের আগমন (১০ম নববী বর্ষে):
(৫) হুমকি, লোভনীয় প্রস্তাব ও বয়কট কোনটাতে কাজ না হওয়ায় এবং ইতিমধ্যে হামযাহ ও ওমরের ইসলাম গ্রহণ করায় এবং আবু তালিবের স্বাস্থ্যহানির খবর শুনে মক্কার নেতারা শেষবারের মত তাঁর সাথে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত নেন। সেমতে আবু জাহল, আবু সুফিয়ান, উমাইয়া বিন খালাফ, ওৎবা ও শায়বা বিন রাবী ‘আহ সহ প্রায় ২৫ জন নেতা আবু তালেবের কাছে আসেন এবং বলেন, হে আবু তালেব! আপনি যে মর্যাদার আসনে আছেন, তা আপনি জানেন। আপনার বর্তমান অবস্থাও আপনি বুঝতে পারছেন।
আমরা আপনার জীবনাশংকা করছি। এমতাবস্থায় আপনি ভালভাবে জানেন যা আমাদের ও আপনার ভাতিজার মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। এক্ষণে আপনি তাকে ডাকুন এবং উভয় পক্ষে অঙ্গীকার নিন যে, সে আমাদের ও আমাদের দ্বীন থেকে বিরত থাকবে এবং আমরাও তার থেকে বিরত থাকব। তখন আবু তালেব রাসূল (সাঃ)-কে ডাকালেন। অতঃপর রাসূল (সাঃ) তাদের সম্মুখে এসে বললেন,
‘হাঁ, একটি কলেমার ওয়াদা আপনারা আমাকে দিন। তাতে আপনারা আরবের বাদশাহী পাবেন এবং অনারবরা আপনাদের অনুগত হবে’। আবু জাহ্ল খুশী হয়ে বলে উঠল, তোমার পিতার কসম, এমন হলে একটা কেন দশটা কলেমা পাঠ করতে রাযী আছি। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন
‘আপনারা বলুন, ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং এতদ্ব্যতীত যাদের পূজা করেন, সব পরিত্যাগ করুন’।
তখন সবাই দু’হাতে তালি বাজিয়ে বলে উঠলো ‘সব উপাস্য বাদ দিয়ে তুমি একজন উপাস্য চাও? নিশ্চয়ই তোমার এ কাজ বড়ই বিস্ময়কর!’ অতঃপর তারা একথা বলতে বলতে চলে গেল যে,‘চলো! তোমরা তোমাদের বাপ-দাদার ধর্মের উপরে চলতে থাক, যতক্ষণ না আল্লাহ তোমাদের ও তার মধ্যে একটা ফায়ছালা করেন’। এ প্রসঙ্গেই আল্লাহ সূরা ছোয়াদের ১ হতে ৭ আয়াত সমূহ নাযিল করেন-
ص- وَالْقُرْآنِ ذِي الذِّكْرِ- بَلِ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فِيْ عِزَّةٍ وَّشِقَاقٍ- كَمْ أَهْلَكْنَا مِنْ قَبْلِهِم مِّنْ قَرْنٍ فَنَادَوْا وَلاَتَ حِيْنَ مَنَاصٍ- وَعَجِبُ وْا أَنْ جَاءَهُمْ مُّنْذِرٌ مِّنْهُمْ وَقَالَ الْكَافِرُوْنَ هَذَا سَاحِرٌ كَذَّابٌ- أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَهاً وَاحِداً إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ- وَانْطَلَقَ الْمَلَأُ مِنْ هُمْ أَنِ امْشُوْا وَاصْبِرُوْا عَلَى آلِهَتِكُمْ إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ يُرَادُ- مَا سَمِعْنَا بِهَذَا فِيْ الْمِلَّةِ الْآخِرَةِ إِنْ هَذَا إِلاَّ اخْتِلاَقٌ-
(i) ছোয়াদ- শপথ উপদেশপূর্ণ কুরআনের
(ii) বরং কাফের দল অহমিকা ও হঠকারিতায় লিপ্ত
(iii) তাদের পূর্বেকার বহু জনগোষ্ঠীকে আমরা ধ্বংস করেছি। তারা আর্তনাদ করেছে। কিন্তু নিষ্কৃতি লাভের উপায় তাদের ছিল না
(iv) তারা বিস্ময়বোধ করে যে, তাদের কাছে তাদেরই মধ্য থেকে একজন সতর্ককারী আগমন করেছেন। আর কাফেররা বলে এতো একজন জাদুকর ও মহা মিথ্যাবাদী
(v) সে কি বহু উপাস্যের বদলে একজন উপাস্যকে সাব্যস্ত করে? নিশ্চয় এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার
(vi) তাদের নেতারা একথা বলে চলে যায় যে, তোমরা তোমাদের উপাস্যদের পূজায় দৃঢ় থাকো। নিশ্চয়ই (মুহাম্মাদের) এ বক্তব্য কোন বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণোদিত
(vii) আমরা তো আমাদের সাবেক ধর্মে এ ধরনের কোন কথা শুনিনি। এটা মনগড়া উক্তি ভিন্ন কিছুই নয়’।
মৃত্যুকালে আগমন (১০ নববী বর্ষে):
(৬) শেষবার নেতারা এসেছিলেন আবু তালিবের মৃত্যুকালে, যেন তিনি তাওহীদের কালেমা পাঠ না করেন ও বাপ-দাদাদের ধর্মে শিরকের উপর মৃত্যুবরণ করেন, সেটা নিশ্চিত করার জন্য। বস্ত্তত একাজে তারা সফল হয়েছিলেন। রাসূলের শত আকুতি উপেক্ষা করে সেদিন আবু তালেব আবু জাহলের কথায় সায় দিয়ে শিরকের উপর মৃত্যুবরণ করেন।
সাহাবীগণের উপর অত্যাচার
★★★ নিম্নে উদাহরণ স্বরূপ জাহেলী যুগের নির্যাতনের কিছু দৃষ্টান্ত পেশ করা হল।-
(১) মদীনায় প্রেরিত ইসলামের প্রথম দাঈ মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ) ইসলাম কবুল করেছেন, এ সংবাদ জানতে পেরে তার মা তার খানাপিনা বন্ধ করে দেন। অবশেষে বাড়ি থেকে বহিষ্কার করেন। বিলাস-ব্যসনে লালিত-পালিত এই তরুণ অবশেষে ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর হয়ে অস্থি-চর্মসার ও কংকাল সর্বস্ব হয়ে পড়েছিলেন। ইনি ওহোদের যুদ্ধে শহীদ হন।
(২) ইসলামের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ মুওয়াযযিন বেলাল বিন রাবাহ (রাঃ) কুরায়েশ নেতা উমাইয়া বিন খালাফের হাবশী ক্রীতদাস ছিলেন। ইসলাম কবুল করার অপরাধে তাকে তার মনিব নানাবিধ নির্যাতন করে। তার হাত-পা বেঁধে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে প্রখর রৌদ্রে উত্তপ্ত বালুকার উপর উপুড় করে পাথর চাপা দিয়ে ফেলে রাখা হত।
কখনো তার গলায় দড়ি বেঁধে গরু-ছাগলের মত ছেলে-ছোকরাদের দিয়ে পাহাড়ে ও প্রান্তরে টেনে-হিচঁড়ে নেওয়া হত। যাতে তার গলার চামড়া রক্তাক্ত হয়ে যেত। খানা-পিনা বন্ধ রেখে ক্ষুৎ-পিপাসায় কষ্ট দেওয়া হত। কখনো উত্তপ্ত কংকর-বালুর উপরে হাত-পা বেঁধে ফেলে রেখে বুকে পাথর চাপা দেওয়া হত আর বলা হত
‘মুহাম্মাদের দ্বীন পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তোকে আমৃত্যু এভাবেই পড়ে থাকতে হবে’।
কিন্তু বেলাল শুধুই বলতেন ‘আহাদ’ ‘আহাদ’। একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পাশ দিয়ে যাবার সময় এই দৃশ্য দেখে বললেন
أحد ينجيك ‘আহাদ’ অর্থাৎ আল্লাহ তোমাকে মুক্তি দেবেন’।
অতঃপর তিনি আবু বকরকে যেয়ে বললেন, হে আবুবকর। বেলাল আল্লাহর পথে শাস্তি ভোগ করছে’। আবুবকর ইঙ্গিত বুঝলেন। অতঃপর উমাইয়ার দাবী অনুযায়ী নিজের কাফের গোলাম নিসতাস এর বিনিময়ে এবং একটি মূল্যবান চাদর ও দশটি উকিয়ার (স্বর্ণমুদ্রা) বিনিময়ে তাকে খরিদ করে মুক্ত করে দেন।
(৩) খাববাব ইবনুল আরিত বনু খোযা‘আ গোত্রের জনৈকা মহিলার গোলাম ছিলেন। মুসলমান হওয়ার অপরাধে মুশরিক নেতারা তার উপরে লোমহর্ষক নির্যাতন চালায়। নানাবিধ অত্যাচারের মধ্যে সবচাইতে মর্মান্তিক ছিল এই যে, তাকে কাঠের জ্বলন্ত অঙ্গারের উপরে চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে বুকের উপরে পাথর চাপা দেওয়া হয়েছিল।
ফলে পিঠের চামড়া ও মাংস গলে অঙ্গার নিভে গিয়েছিল। ওমর ফারূক (রাঃ) স্বীয় খেলাফতকালে একদিন খাববাবের পিঠের কুঞ্চিত সাদা চামড়া দেখে ও তার উপরে অত্যাচারের কাহিনী শুনে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলেন।
(৪) ইয়াসির পরিবার: ইয়াসির বনু মাখযূমের ক্রীতদাস ছিলেন। তিনি ও তার স্ত্রী ও পুত্র মুসলমান হন। ফলে তাদের উপরে যে ধরনের অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছিল, তা ভাষায় বর্ণনার যোগ্য নয়। আবু জাহলের নির্দেশে বনু মাখযূমের এই ক্রীতদাস মুসলিম পরিবারের উপরে নৃশংসতম শাস্তি নেমে আসে। তাদেরকে খোলা ময়দানে নিয়ে উত্তপ্ত বালুকার উপরে শুইয়ে রেখে নানাভাবে নির্যাতন করা হ’ত। একদিন চলার পথে তাদের এই আযাবের দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের উদ্দেশ্যে বলেন,
صبرًا آل ياسر فإن موعدكم الجنة ‘ধৈর্য ধর হে ইয়াসির পরিবার! তোমাদের ঠিকানা হল জান্নাত’
ইয়াসিরের দুই পায়ে দুটি রশি বেঁধে দুদিকে দুটি উটের পায়ে উক্ত রশির অন্য প্রান্ত বেঁধে দিয়ে উট দুটিকে দুদিকে জোরে হাঁকিয়ে নেওয়া হয়। তাতে জোরে হেঁচকা টানে ইয়াসিরের দেহ দ্বিখন্ডিত হয়ে যায় এবং সেখানেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
অতঃপর পাষাণহৃদয় আবু জাহল নিজ হাতে ইয়াসিরের স্ত্রী সুমাইয়ার গুপ্তাঙ্গে বর্শা বিদ্ধ করে তাকে হত্যা করে। তিনিই ছিলেন ইসলামে প্রথম মহিলা শহীদ। অতঃপর তাদের একমাত্র পুত্র আম্মারের উপরে শুরু হয় অবর্ণনীয় নির্যাতনের পালা। তাকে উত্তপ্ত কংকরময় বালুর উপরে হাত পা বেঁধে পাথর চাপা দিয়ে ফেলে রাখা অবস্থায় নির্যাতন করা হয়।
একদিন আম্মারকে পানিতে চুবিয়ে আধামরা অবস্থায় উঠিয়ে বলা হল, তুমি যতক্ষণ মুহাম্মাদকে গালি না দিবে এবং লাত-মানাত-উযযা দেব-দেবীর প্রশংসা না করবে, ততক্ষণ তোমাকে মুক্তি দেওয়া হবে না। অবশেষে বাধ্য হয়ে তিনি তাদের কথা মেনে নেন। পরেই তিনি রাসূলের দরবারে গিয়ে কান্না-জড়িত কণ্ঠে সব ঘটনা খুলে বললেন ও আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তখন নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়-
مَنْ كَفَرَ بِاللهِ مِنْ بَعْدِ إيْمَانِهِ إِلاَّ مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيْمَانِ-
‘ঈমান আনার পরে যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কুফরী করে তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর ক্রোধ এবং কঠিন শাস্তি। কিন্তু যাকে বাধ্য করা হয়, অথচ তার অন্তর বিশ্বাসে অটল থাকে (তার জন্য কোন চিন্তা নেই)’ (নাহল ১৬/১০৬)।
(৫) হযরত ওছমানের মত ধনশালী ব্যক্তি যখন ইসলাম কবুল করেন, তখন তাঁর বদবখ্ত চাচা তাঁকে খেজুর পাতার চাটাইয়ে জড়িয়ে বেঁধে নীচ থেকে ধোঁয়া দিয়ে শাস্তি দেয়।
(৬) কোন কোন ছাহাবীকে উট বা গরুর কাঁচা চামড়ায় জড়িয়ে প্রখর রৌদ্র তাপের মধ্যে ফেলে রাখা হয়। কাউকে লোহার বর্ম পরিয়ে উত্তপ্ত পাথরের উপরে শুইয়ে রাখা হত।
(৭) যানীরাহ, নাহদিয়াহ ও তার মেয়ে এবং উম্মে আবীস প্রমুখ ক্রীতদাসীরা মুসলমান হলে বর্বরতম নির্যাতনের শিকার হন। আবুবকর তাদেরকে খরিদ করে মুক্ত করে দেন। এভাবে কুরায়েশ নেতারা মুসলিম দাস-দাসী ও তাদের পরিবারের উপরে সর্বাধিক নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করত। আবুবকর (রাঃ) এইসব নির্যাতিত দাস-দাসীকে বহু মূল্যের বিনিময়ে তাদের নিষ্ঠুর মনিবদের নিকট থেকে খরিদ করে নিয়ে মুক্ত করে দিতেন।
(৮) খোদ আবুবকর (রাঃ)-কে একদিন ওৎবা বিন রাবী‘আহ তার লোকজন নিয়ে একদিন হঠাৎ আক্রমণ করে বসে। মর্মান্তিক প্রহারে তাঁর চেহারা এমন ফুলে যায় যে, তাকে চেনাই যাচ্ছিল না। বানু তামীম তাকে অজ্ঞান অবস্থায় বাড়ী নিয়ে আসে। সন্ধ্যার পরে তাঁর জ্ঞান ফিরলে প্রথমে জিজ্ঞেস করেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কেমন আছেন?
শত চেষ্টায়ও তিনি কিছু খেলেন না! অবশেষে খাত্তবাব কন্যা উম্মে জামীল এসে গোপনে তাকে খবর দেন যে, রাসূল (সাঃ) ভাল আছেন এবং এখন আরক্বামের গৃহে অবস্থান করছেন। তারপর রাত্রি অধিক হলে উম্মে জামীলের সাথে তিনি আরক্বামের গৃহে যান। সেখানে রাসূলকে দেখার পর কুশল জেনে নিয়ে পানাহার করেন।
আরক্বামের গৃহে প্রচার কেন্দ্র (৫ম নববী বর্ষ):
মুসলমানগণ পাহাড়ের পাদদেশে ও বিভিন্ন গোপন স্থানে মিলিত হয়ে জামাআতের সাথে ছালাত আদায় করতেন এবং দ্বীনের তালীম নিতেন। একদিন কতিপয় মুশরিক এটা দেখে ফেলে এবং মুসলমানদের অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিতে দিতে তাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন হযরত সা‘দ বিন আবী ওয়াকক্বাছ (রাঃ) তাদেরকে পাল্টা আক্রমণ করে রক্তাক্ত করে ফেলেন। ফলে তারা পালিয়ে যায়। এ কারণেই হযরত সা‘দকে ‘আল্লাহর রাস্তায় প্রথম বর্শা নিক্ষেপকারী’ বলা হয়। এটি ছিল চতুর্থ নববী বর্ষের ঘটনা।
এই ঘটনার পরে ৫ম নববী বর্ষে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আরক্বাম বিন আবুল আরক্বামের বাড়িটিকে প্রশিক্ষণ ও প্রচার কেন্দ্র হিসাবে বেছে নেন। বাড়িটি ছিল ছাফা পাহাড়ের উপরে। যা ছিল অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এবং মুশরিকদের দৃষ্টির আড়ালে। কাফের নেতাদের সম্মেলনস্থল ‘দারুন নাদওয়া’ থেকে এটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন স্থানে। যদিও আল্লাহর রাসূল (সাঃ) নিজে সর্বদা প্রকাশ্যে ছালাত আদায় করতেন।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর অত্যাচার
★★★ সমস্ত যুক্তি, কৌশল ও আপোষ প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ার পর আবু লাহাবের নেতৃত্বে কুরায়েশ নেতাদের মধ্য থেকে ২৫ জনের একটি কমিটি গঠিত হয় এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথীদের বিরুদ্ধে এখন থেকে কঠোরতম নির্যাতন চালাতে হবে। মুসলিমরা অধিকাংশই সমাজের দুর্বল শ্রেণীর। আবু বকর, ওছমান প্রমুখ যারা উচ্চ শ্রেণীর আছেন, তারা ভদ্র মানুষ।
দুষ্টদের অভদ্রতার সামনে তারা মুহাম্মাদকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখেন না। সমস্যা হল খোদ মুহাম্মাদ ও তাঁর চাচা আবু তালেবকে নিয়ে। এ দুজনই অত্যন্ত সম্মানিত ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। তাদের উপরে হস্তক্ষেপ করলে তাদের দুটি গোত্র বনু হাশেম ও বনু মুত্তালিব ঝাঁপিয়ে পড়বে। যদিও তারা মুশরিক। সবদিক ভেবেচিন্তে তারা দুর্বল মুসলমানদের উপরে নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি করার সাথে সাথে মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে দৈহিকভাবে ও মানসিকভাবে অপদস্থ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। যেমন-
১. রাসূলের উপর প্রতিবেশীদের অত্যাচার:
আবু লাহাব ছিল রাসূলের চাচা ও নিকটতম প্রতিবেশী। সে ও তার স্ত্রী ছাড়াও অন্যতম প্রতিবেশী ছিল হাকাম বিন আবুল ‘আছ বিন উমাইয়া, উক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব, আদী বিন হামরা ছাক্বাফী, ইবনুল আছদা আল-হুযালী। এদের মধ্যে কেবল হাকাম বিন আবুল ‘আছ বিন উমাইয়া ইসলাম কবুল করেছিলেন। কাফেররা মুসলিমদের বাড়ির যবেহ করা দুম্বা-ভেড়ার নাড়ি-ভুঁড়ি তারা রাসূলের বাড়ীর মধ্যে ছুঁড়ে মারত।
তাদের বাড়ীর আবর্জনাসমূহ রাসূলের রান্না ঘরের মধ্যে নিক্ষেপ করত যাতে রান্না অবস্থায় সব তরকারি নষ্ট হয়ে যায়। রাসূল সেগুলি কুড়িয়ে এনে দরজায় খাড়া হয়ে তাদের ডাক দিয়ে বলতেন ‘হে বনু আবদে মানাফ! এটা কেমন প্রতিবেশী সূলভ আচরণ?’এরপর তিনি সেগুলি দূরে ফেলে আসতেন।
২. কা‘বা গৃহে ছালাতরত অবস্থায় কষ্টদান:
আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন যে, একদিন রাসূল (সাঃ) বায়তুল্লাহ্র পাশে ছালাত আদায় করছিলেন। আবু জাহল ও তার সাথীরা অদূরে বসেছিল। কিছুক্ষণ পর তার নির্দেশে ভুঁড়ি এনে সিজদারত রাসূলের দুই কাঁধের মাঝখানে চাপিয়ে দিল, যাতে ঐ বিরাট ভুড়ির চাপে ও দূর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান। ইবনু মাসঊদ বলেন, আমি সব দেখছিলাম।
কিন্তু এই অবস্থায় আমার কিছুই করার ক্ষমতা ছিল না। অন্যদিকে শত্রুরা দানবীয় উল্লাসে ফেটে পড়ছিল। এই সময় কিভাবে এই দুঃসংবাদ ফাতেমার কানে পৌঁছলে তিনি দৌঁড়ে এসে ভুঁড়িটি সরিয়ে দিয়ে পিতাকে সাক্ষাত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচান। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মাথা উঁচু করে তিনবার বলেন,
‘হে আল্লাহ তুমি কুরায়েশকে ধরো (তিনবার)! হে আল্লাহ তুমি আমর ইবনে হেশাম আবু জাহলকে ধরো। হে আল্লাহ তুমি উৎবা ও শায়বাহ বিন রাবী‘আহ, অলীদ বিন উৎবা, উমাইয়া বিন খালাফ, ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব এবং উমারাহ বিন অলীদকে ধরো’। ইবনু মাস‘ঊদ বলেন, আমি তাদের (উক্ত ৭ জনের) সবাইকে বদর যুদ্ধে নিহত হয়ে কূয়ায় নিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখেছি’। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৮৪৭; ‘রাসূলের আবির্ভাব ও অহি-রসূচনা’ অনুচ্ছেদ।)
৩. সম্মুখে ও পশ্চাতে নিন্দা করা ও অভিশাপ দেওয়া:
এ ব্যাপারে উমাইয়া বিন খালাফ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সে পশ্চাতে সর্বদা নিন্দা করত। তাছাড়া রাসূলকে দেখলেই তাঁর সামনে গিয়ে যাচ্ছে তাই বলে নিন্দা ও ভৎর্সনা করত এবং তাঁকে অভিশাপ দিত। এ প্রসঙ্গেই নাযিল হয়,
وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ
‘প্রত্যেক সম্মুখ নিন্দাকারী ও পশ্চাতে নিন্দাকারীর জন্য রয়েছে ধ্বংস’ (হুমাযাহ১০৪/১)।
৪. রাসূলের মুখে থুথু নিক্ষেপ করা:
(ক) উমাইয়া বিন খালাফের ভাই উবাই বিন খালাফ ছিল আরেক দুরাচার। সে যখন শুনতে পেল যে, ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব রাসূলের কাছে বসে কিছু আল্লাহর বাণী শুনেছে, তখন ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে ওক্ববাকে বাধ্য করল যাতে সে তৎক্ষণাৎ গিয়ে রাসূলের মুখে থুথু নিক্ষেপ করে আসে। ওক্ববা তাই-ই করল।
(খ) অনুরূপ এক ঘটনায় একদিন আবু লাহাবের পুত্র উতায়বা বিন আবু লাহাব এসে রাসূল (সাঃ)-কে বলল, আমি সূরা নাজমের ১ ও ৮ আয়াত (وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى- ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى) দু’টিকে অস্বীকার করি বলেই একটা হেঁচকা টানে রাসূলের গায়ের জামা ছিঁড়ে দিল এবং তাঁর মুখে থুথু নিক্ষেপ করল। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তখন তাকে বদ দোআ করে বললেন, اللهم سلط عليه كلبا من كلابك ‘আল্লাহ তুমি এর উপরে তোমার কোন একটি কুকুরকে বিজয়ী করে দাও’ । কিছুদিন পরে ওতায়বা সিরিয়ায় ব্যবসায়িক সফরে গেলে সেখানে যারক্বা নামক স্থানে রাত্রি যাপন করে।
এমন সময় হঠাৎ একটা বাঘকে সে তাদের চারপাশে ঘুরতে দেখে ভয়ে বলে উঠল, ‘আল্লাহর কসম! এ আমাকে খেয়ে ফেলবে। এভাবেই তো মুহাম্মাদ আমার বিরুদ্ধে দো‘আ করেছিল। সে আমাকে হত্যা করল। অথচ সে মক্কায় আর আমি শামে’। পরদিন সকালে বাঘ এসে সবার মধ্য থেকে তাকে ধরে নিয়ে ঘাড় মটকে হত্যা করল।
৫. রাসূলের মুখে পচা হাড্ডি চূর্ণ ছুঁড়ে মারা :
উবাই বিন খালাফ নিজে একবার মরা-পচা হাড্ডি চূর্ণ করে রাসূলের কাছে গিয়ে তাঁর মুখের দিকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়। যাতে তাঁর মুখ ভর্তি হয়ে যায় এবং দুর্গন্ধে বমি হবার উপক্রম হয়।
৬. তার সামনে এসে মিথ্যা শপথ করা এবং পরে চোগলখুরী করা:
রাসূলকে নির্যাতনকারীদের মধ্যে অন্যতম সেরা বদমাশ ছিল আখনাস বিন শুরাইক্ব ছাক্বাফী। সে ভাল মানুষ সেজে রাসূলের সামনে মিথ্যা শপথ করে কথা বলত এবং পরে লোকদের কাছে গিয়ে চোগলখুরী করত। আল্লাহ পাক তার নয়টি বদ স্বভাবের কথা বর্ণনা করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَلَا تُطِعْ كُلَّ حَلاَّفٍ مَّهِينٍ- هَمَّازٍ مَّشَّاءٍ بِنَمِيْمٍ- مَنَّاعٍ لِّلْخَيْرِ مُعْتَدٍ أَثِيْمٍ- عُتُلٍّ بَعْدَ ذَلِكَ زَنِيْمٍ-
‘আপনি কথা শুনবেন না ঐ ব্যক্তির, যে অধিক শপথকারী ও হীন স্বভাব বিশিষ্ট’। ‘যে সম্মুখে নিন্দা করে এবং একের কথা অন্যকে লাগিয়ে চোগলখুরী করে’। ‘সে ভালকাজে অধিকহারে বাধাদানকারী, সীমা লংঘনকারী ও পাপিষ্ঠ’। ‘রুক্ষ স্বভাবী এবং সে জারজ সন্তান’ (ক্বলম৬৮/১০-১৩)।
ক্বিয়ামতের দিন তার নাসিকা দাগিয়ে দিয়ে চিহ্নিত করে দেওয়া হবে এজন্য যে, অন্যের সামনে তার লাঞ্ছনা যেন পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। দুনিয়াতে সে রাসূলের দাওয়াত থেকে নাক সিটকিয়েছিল, তাই ক্বিয়ামতের দিন তার বদলা হিসাবে তার নাসিকা দাগানো হবে। একাজ অন্যেরা করলেও তার পাপ ছিল বেশী এবং সে ছিল নেতা। তাই তাকে সেদিন চিহ্নিত করে দেওয়া হবে।
৭. রাসূলের সামনে বসে কুরআন শোনার পর তাঁকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে গর্বের সাথে বুক ফুলিয়ে চলে যাওয়া:
এ কাজটা প্রায়ই আবু জাহল করত, আর ভাবত আমি মুহাম্মাদকে ও তাঁর কুরআনকে গালি দিয়ে একটা দারুণ কাজ করলাম। অথচ তার এই কুরআন শোনাটা ছিল কপটতা এবং লোককে একথা বুঝানো যে, আমার মত আরবের সেরা জ্ঞানী ব্যক্তির নিকটেই যখন কুরআনের কোন মূল্য নেই, তখন তোমরা কেন এর পিছনে ছুটবে? আবু জাহলের এই কপট ও গর্বিত আচরণের কথা বর্ণনা করেন আল্লাহ এভাবে-
فَلَا صَدَّقَ وَلَا صَلَّى- وَلَكِنْ كَذَّبَ وَتَوَلَّى- ثُمَّ ذَهَبَ إِلَى أَهْلِهِ يَتَمَطَّى-
‘সে বিশ্বাস করেনি এবং ছালাত আদায় করেনি’। ‘পরন্তু সে মিথ্যারোপ করেছে ও পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছে’। ‘অতঃপর সে দম্ভভরে নিজ পরিবারের কাছে ফিরে গিয়েছে’ (ক্বিয়ামাহ৭৫/৩১-৩৩)।
৮. কা‘বা গৃহে ছালাত আদায়ে নানারূপ বাধা সৃষ্টি :
(ক) প্রথম দিকে সকালে ও সন্ধ্যায় দু’রাক‘আত করে ছালাত আদায়ের নিয়ম ছিল। প্রথম তিন বছর সকলে সেটা গোপনে আদায় করতেন। পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এটা প্রকাশ্যে কা‘বা গৃহে আদায় করতে থাকেন। একদিন তিনি ছালাত আদায় করছেন। এমন সময় আবু জাহল গিয়ে তাঁকে ধমকের সুরে বলল, ألم أنهك عن هذا يا محمد! ‘হে মুহাম্মাদ! আমি কি তোমাকে এসব করতে নিষেধ করিনি’? তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে পাল্টা ধমক দেন। এতে সে বলে,
بأى شيء تهددنى يا محمد أما والله إنى لأكثر هذا الوادى ناديًا.
‘কিসের জোরে তুমি আমাকে ধমকাচ্ছ। আল্লাহর কসম! মক্কার এই উপত্যকায় আমার বৈঠক সবচেয়ে বড়’। অর্থাৎ আমার দল সবচেয়ে বড়। তখন আল্লাহ সূরা আলাক্ব-এর নিম্নোক্ত আয়াত গুলি নাযিল করেন।(তিরমিযীহা/৩৩৪৯, সিলসিলাছাহীহাহহা/২৭৫। )
كَلَّا إِنَّ الْإِنسَانَ لَيَطْغَى- أَن رَّآهُ اسْتَغْنَى- إِنَّ إِلَى رَبِّكَ الرُّجْعَى- أَرَأَيْتَ الَّذِي يَنْهَى- عَبْداً إِذَا صَلَّى- أَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ عَلَى الْهُدَى- أَوْ أَمَرَ بِالتَّقْوَى- َرَأَيْتَ إِنْ كَذَّبَ وَتَوَلَّى- أَلَمْ يَعْلَمْ بِأَنَّ اللَّهَ يَرَى- كَلَّا لَئِن لَّمْ يَنتَهِ لَنَسْفَعاً بِالنَّاصِيَةِ- نَاصِيَةٍ كَاذِبَةٍ خَاطِئَةٍ- فَلْيَدْعُ نَادِيَه- سَنَدْعُ الزَّبَانِيَةَ- كَلَّا لَا تُطِعْهُ وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ-
‘কখনোই না। সত্য-সত্যই মানুষ সীমা লংঘন করে’। ‘এ কারণে যে, সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে’। ‘নিশ্চয়ই আপনার প্রভুর দিকেই সবার প্রত্যাবর্তন হবে’। ‘আপনি কি তাকে (আবু জাহলকে) দেখেছেন যে নিষেধ করে’? ‘এক বান্দাকে (রাসূলকে) যখন সে ছালাত আদায় করে’। ‘আপনি কি দেখেছেন যদি সে সৎপথে থাকে’। ‘অথবা আল্লাহ ভীতির নির্দেশ দেয়’। ‘আপনি কি দেখেছেন যদি সে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়’। ‘সে কি জানেনা যে, (তার ভাল মানুষী ও মিথ্যাচার সবই) আল্লাহ দেখেন’। ‘কখনোই না’, যদি সে বিরত না হয়, তবে আমি তার মাথার সামনের কেশগুচ্ছ ধরে কষে টান দেব’। ‘মিথ্যুক পাপিষ্ঠের কেশগুচ্ছ’। ‘অতএব সে তার পারিষদবর্গকে ডাকুক’। ‘আমরাও ডাকব আযাবের ফেরেশতাদের’। ‘কখনোই না। আপনি তার কথা শুনবেন না। আপনি সিজদা করুন ও (আপনার প্রভুর) নৈকট্য তালাশ করুন’ (আলাক্ব৯৬/৬-১৯)।
আবু জাহল ও রাসূলের মধ্যকার এই ঘটনা স্মরণ করে এই আয়াত পাঠের পর পাঠক ও শ্রোতাকে সিজদা করার বিধান দেওয়া হয়েছে’।(মুসলিম, মিশকাতহা/১০২৪ ‘ছালাত’ অধ্যায়, ২১অনুচ্ছেদ) ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এতদ্ব্যতীত আবু জাহল অন্যান্যদেরকে প্ররোচিত করেছিল যে, মুহাম্মাদ যখন কুরআন তেলাওয়াত করে তখন তোমরা হৈ-হুল্লোড় ও হট্টগোল করবে, যাতে কেউ তার তেলাওয়াত শুনতে না পায়। এ প্রসঙ্গে আয়াত নাযিল হয়-
وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لاَ تَسْمَعُوْا لِهَذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيْهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُوْنَ- فَلَنُذِيْقَنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا عَذَاباً شَدِيْداً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَسْوَأَ الَّذِيْ كَا نُوْا يَعْمَلُوْنَ-
‘আর কাফেররা বলে যে, তোমরা এ কুরআন শুনোনা এবং এর তেলাওয়াত কালে হট্টগোল কর, যাতে তোমরা জয়ী হও’। ‘আমরা অবশ্যই কাফিরদের কঠিন আযাব আস্বাদন করাব এবং আমরা অবশ্যই তাদের কাজের হীনতম বদলা নেব’ (হামীম সাজদাহ ৪১/২৬-২৭)।
এইভাবে হোটেলে ও বাজারে ব্যস্ততার সময় মাইকে কুরআন তেলাওয়াতের ক্যাসেট চালানোও ঠিক নয়। কেননা কুরআন শোনার জন্য মনোযোগ দেওয়া শর্ত। অথচ ঐ সময় মনোযোগ দেওয়া যায় না।
১০. সত্যনবী হ’লে তাকে অমান্য করায় গযব নাযিল হয় না কেন বলে যুক্তি প্রদর্শন করা:
নযর বিন হারিছ প্রমুখ কুরায়েশ নেতারা নও মুসলিমদের সম্মুখে এবং নিজেদের লোকদের সম্মুখে জোরে-শোরে একথা প্রচার করত যে, যদি মুহাম্মাদ সত্য নবী হতেন ও তার আনীত কুরআন সত্য কিতাব হয়ে থাকে, তাহলে তা অমান্য করার অপরাধে আমাদের উপরে গযব নাযিল হয় না কেন? বস্ত্ততঃ তাদের এসব কথা দ্বারা দুর্বলদের মন আরও দুর্বল হয়ে যেত এবং ইসলাম গ্রহণ করা হতে মানুষ পিছিয়ে যেত। তাদের এই দাবী ও তার জওয়াবে আল্লাহ বলেন,
وَإِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آيَاتُنَا قَالُوْا قَدْ سَمِعْنَا لَوْ نَشَاءُ لَقُلْنَا مِثْلَ هَـذَا إِنْ هَـذَا إِلاَّ أَسَاطِيْرُ الْأَوَّلِيْنَ- وَإِذْ قَالُوْا اللَّهُمَّ إِنْ كَانَ هَـذَا هُ وَ الْحَقَّ مِنْ عِنْدِكَ فَأَمْطِرْ عَلَيْنَا حِجَارَةً مِّنَ السَّمَاءِ أَوِ ائْتِنَا بِعَذَابٍ أَلِيْمٍ- وَمَا كَانَ اللهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيْهِمْ وَمَا كَانَ اللهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ-
‘যখন তাদের নিকটে আমাদের আয়াত সমূহ পাঠ করা হয়, তখন তারা (তাচ্ছিল্যের সাথে) বলে, আমরা শুনেছি, ইচ্ছা করলে আমরাও এরূপ বলতে পারি। এসব তো পূর্ববর্তীদের উপকথা ভিন্ন কিছুই নয়’। ‘এতদ্ব্যতীত যখন তারা বলতে আরম্ভ করে যে, হে আল্লাহ! যদি এটাই তোমার নিকট থেকে আগত সত্য দ্বীন হয়ে থাকে, তাহ’লে তুমি আমাদের উপরে আসমান থেকে প্রস্তর বর্ষণ কর কিংবা আমাদের উপরে বেদনাদায়ক আযাব নাযিল কর’। ‘অথচ আল্লাহ কখনোই তাদের উপরে আযাব নাযিল করবেন না, যতক্ষণ আপনি তাদের মধ্যে অবস্থান করবেন। তাছাড়া তারা (দুর্বল মুসলমানেরা) যতক্ষণ ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে, আল্লাহ কখনো তাদের উপরে আযাব দিবেন না’ (আনফাল ৮/৩১-৩৩)।
আয়াত তিনটির মর্মকথা:
উপরোক্ত তিনটি আয়াতের মধ্যে প্রথম আয়াতে কাফেররা ‘কুরআনকে পুরাকালের ইতিকথা এবং ইচ্ছা করলে আমরাও এরূপ বলতে পারি’ বলে দম্ভ প্রকাশ করেছে। অথচ ঐ নেতারা নিজেরাই গোপনে রাতের অন্ধকারে বাইরে দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদের ছালাতে রাসূলের সুমধুর তেলাওয়াত শুনত। আর ফিরে যাওয়ার সময় মন্তব্য করত ليس هذا كلام البشر ‘এটা কখনোই মানুষের কালাম নয়’।
দ্বিতীয় আয়াতে কাফের নেতাদের আরেকটি কৌশল বর্ণিত হয়েছে যে, মুহাম্মাদ সত্যনবী হলে তাকে অমান্য করার কারণে আমাদের উপরে গযব নাযিল হয় না কেন? অথচ তারা ভালভাবেই জানত যে, আল্লাহ তার বান্দাকে বুঝবার ও তওবা করার অবকাশ দিয়ে থাকেন।
তারা রাসূলকে ‘ছাবেঈ’ (صابئ) অর্থাৎ বিধর্মী, ও ‘কাযযাব’ (كذّاب) অর্থাৎ ‘মহা মিথ্যাবাদী’ এবং ‘সমাজে বিভক্তি সৃষ্টিকারী’ বলেছিল। আর সেকারণ তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বর্তমান যুগে ইসলামের শত্রুরা দ্বীনের সত্যিকারের সেবকদের বিরুদ্ধে একই অপবাদ ও একই কৌশল অবলম্বন করেছে। তারাও আল্লাহর গযব সঙ্গে সঙ্গে নাযিল না হওয়াকে তাদের সত্যতার পক্ষে দলীল হিসাবে পেশ করে এবং সমাজ সংস্কারক দ্বীনদার ব্যক্তির অত্যাচারিত হওয়াকে তার অসত্য হওয়ার প্রমাণ হিসাবে যুক্তি পেশ করে থাকে।
তৃতীয় আয়াতে আল্লাহ কাফেরদের কথার জওয়াবে বলেন, যতক্ষণ হে মুহাম্মাদ! আপনি তাদের মধ্যে অবস্থান করবেন অথবা আপনার হিজরতের পরেও যতদিন মক্কার দুর্বল ঈমানদারগণ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে, ততদিন আল্লাহ কখনোই তাদের উপর গযব নাযিল করবেন না।
কারণ একজন নবী ও ঈমানদারের মূল্য সমস্ত আরববাসী এমনকি সারা পৃথিবীর সমান নয়। এ কারণেই হাদীছে এসেছে, لاتقوم الساعة حتى لايقال فى الأرض: الله الله ‘অতদিন ক্বিয়ামত হবে না, যতদিন পৃথিবীতে একজন আল্লাহ বলার মত (প্রকৃত তাওহীদপন্থী ঈমানদার) লোক বেঁচে থাকবে’।
১১. রাস্তায় ছেলে-ছোকরাদের লেলিয়ে দেওয়া:
উপরে বর্ণিত অত্যাচার সমূহের সাথে যোগ হল একটি নিষ্ঠুরতম অত্যাচার। সেটি হল নেতাদের কারসাজিতে ছেলে-ছোকরাদের অত্যাচার। যেহেতু ছোট ছেলেদের সাত খুন মাফ। তাই নেতারা তাদের কাজে লাগালো। আধুনিক পরিভাষায় নেতারা হল গডফাদার এবং ছোকরারা হল টিন এজার সন্ত্রাসী।
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) যখন রাস্তায় বেরোতেন, তখনই আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা ছোকরার দল ছুটে আসত। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ওদের সালাম দিতেন। ওরা পাল্টা গালি দিত। তিনি ওদের উপদেশ দিতেন। ওরা তখন হি হি করে অট্টহাস্য করত। এভাবে কোন এক পর্যায়ে যখন ওরা রাসূলের দিকে ঢিল ছুঁড়ে মারা শুরু করত, তখন রাসূল (সাঃ) আবু সুফিয়ানের গৃহে আশ্রয় নিতেন।
তখন ছোকরারা চলে যেত। আবু সুফিয়ান বাহ্যিক সৌজন্য বজায় রাখতেন। সম্ভবতঃ এরই প্রতিদান স্বরূপ মক্কা বিজয়ের রাতে সুফিয়ান গোপন অভিযানে এসে ধরা পড়লে রাসূল (সাঃ) তাকে মাফ করে দেন এবং ঘোষণা দেন, ‘যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের গৃহে আশ্রয় নিবে, সে ব্যক্তি নিরাপদ থাকবে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ইন্তেকাল
★★★ বিদায় হে আমার বন্ধুঃ অন্তিম যাত্রার পথে মহানবী
আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত পূর্ণতা লাভ করেছে, আরব জাহান এখন ইসলামের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। এ সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চিন্তা-চেতন, অনুভব-অনুভূতি, বাহ্যিক আচার-আচরণ ও কথা বার্তায় এমন নিদর্শন প্রকাশ পেতে লাগলো যা থেকে স্পস্টতই বুঝা যাচ্ছিলো যে, তিনি এ পৃথিবীর অধিবাসীদের শীঘ্রই বিদায় জানাবেন।
উদহরণস্বরূপ বলা হয় যে, দশম হিজরীর রমযান মাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ দিন এ’তেকাফ পালন করেন অথচ অন্যান্য রমযানে পালন করতেন দশদিন। হযরত জিবরাঈল (আ.) এ বছর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সমগ্র কোরআন শরীফ দু’বার পাঠ করে শোনালেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছিলেন, আমি জানি না, সম্ভবত এ বছরের পর এই জায়গায় তোমাদের সাথে আমি আর কখনো মিলিত হতে পারব না।
জামরায়ে আকাবার কাছে তিনি বলেন, আমার কাছ থেকে হজ্জ এর নিয়মাবলী শিখে নাও, কেননা আমি এ বছরের পর সম্ভবত আর কখনো হজ্জ করতে পারব না। আইয়ামে তাশরীকের মাঝামাঝি অর্থাৎ ১০,১১,১২ই যিলহজ্জের সময়ে সূরা নসর নাযিল হয়েছিলে। এরপর তিনি বুঝে ফেলেছিলেন যে, এবার দুনিয়া থেকে তার বিদায় নেয়ার পালা। এই সূরা নাযিল হওয়া মানে হচ্ছে তার মৃত্যুবরণের একটা আগাম ইত্তেলা (সংবাদ) দেয়া।
একাদশ হিজরীর সফর মাসের শুরতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহুদ প্রান্তরে গমন করেন। সেখানে তিনি শহীদানদের জন্যে এমনভাবে দোয়া করলেন যেন জীবিতরা মৃতদের কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করছে। এরপর ফিরে এস তিনি মিম্বরে বসে বললেন, আমি তোমাদরে কর্মতৎপরতার আমীর এবং তোমাদের জন্যে সাক্ষী।
আল্লাহর শপথ এখন আমি আমার হাউয অর্থাৎ হাউযে কাওছার দেখতে পাচ্ছি। আমাকে সমগ্র বিশ্ব জাহান এবং এর ধন-ভান্ডারের চাবি প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহর শপথ, আমি এ আশঙ্কা পোষণ করি না যে, তোমরা আমার পরে শেরেক করবে বরং এ আশঙ্কা করছি যে, তোমরা দুনিয়ার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে।
একদিন মধ্য রাতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান্নাতুল বাকির কবরস্থানে যান এবং সেখানে মুর্দাদের জন্যে দোয়া করেন। সে দোয়ায় তিনি বলেন, হে কবরবাসীরা, তোমাদের প্রতি সালাম। মানুষ যে অবস্থায় রয়েছে তার চেয়ে তোমরা যে অবস্থায় রয়েছো তা তোমাদের জন্যে শুভ হোক। ফেতনা আঁধার রাতের অংশের মতো একের পর এক চলে আসছে। পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের চেয়ে মন্দ। এরপর কবরবাসীদরে এ সুখবর প্রদান করেন যে, আমি ও তোমাদরে সাথে এস মিলিত হবো।
একাদশ হিজরীর ২৯ শে সফর, রোববার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান্নাতুল বাকিতে একটি জানাযায় অংশগ্রহণ করেন। ফেরার পথে মাথাব্যথা শুরু হেয় এবং উত্তাপ এতে বেড়ে যে, মাথায় বাঁধা পট্টির ওপর দিয়েও তাপ অনুভব করা গেছে। এটা ছিলো মরণ অসুখের শুরু। তিনি সেই অসুস্থ অবস্থায় এগার দিন নামায পড়ান।অসুখের মোট মেয়াদ ছিলো তের অথবা চৌদ্দ দিন।
জীবনের শেষ সপ্তাহ:
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। এ সময়ে তিনি পবিত্র সহধর্মিনীদের কাছে জিজ্ঞাসা করতেন যে, আমি আগামীকাল কোথায় থাকবো? আমি আগামীকাল কোথায় থাকবো? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ জিজ্ঞাসার তাৎপর্য তাঁর সহধর্মিনীরা বুঝে ফেললেন, তাই তারা বললেন, আপনি যেখানে থাকতে ইচ্ছা করেন হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সেখানেই থাকবেন।
এরপর তিনি হযরত আয়েশা (রা.)এর ঘরে স্থানান্তরিত হলেন। স্থানান্তরের সময় হযরত ফযল ইবনে আব্বাস এবং হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) প্রিয় নবীকে ভর দিয়ে নিয়ে গেলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামরে মাথায় পট্টি বাঁধা, পবিত্র চরণযুগল মাটিতে হেঁচড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় তিনি হযরত আয়েশা (রা.)-এর ঘরে স্থানান্তরিত হলেন এবং জীবনের শেষ সপ্তাহ সেখানেই কাটালেন।
হযরত আয়েশা (রা.)রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে শিক্ষা করা দোয়া সমূহ পাঠ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র দেহে ফুঁ দিতেন এবং বরকতের আশায় তাঁর পবিত্র হাত নিজের দেহে ফেরাতেন।
মৃত্যুর পাঁচদিন আগে চাহার শোম্বা অর্থাৎ বুধবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেহের উত্তাপ অস্বাভাবিক বেড়ে গেলো। এতে তাঁর কষ্ট বাড়লো। তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। এ সময় বললেন, বিভিন্ন কূপের সাত মশক পানি আমার ওপর ঢালো, আমি যেন লোকদের কাছে গিয়ে ওসিয়ত করতে পারি। এ জন্যে বসিয়ে দেয়া হলো এবং দেহে এতো পরিমাণ পানি ঢালা করা হলো যে, তিনি বললেন, ব্যস, ব্যস, অর্থাৎ আর প্রয়োজন নেই।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর কিছুটা সুস্থ বোধ করলেন এবং মসজিদে গেলেন। মাথায় পট্টি বাঁধা ছিলো। মিম্বরে আরোহণ করে বসে কিছু ভাসণ দিলেন। সাহাবায়ে কেরাম আশেপাশে সমবেত ছিলেন। তিনি বললেন, ইহুদি নাছারদের ওপর আল্লাহর লানত, কেননা তারা তাদের নবীর কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে যে, ইহুদী নাছারাদের ওপর আল্লাহর মার, কেননা তারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে। [1]
তিনি আরো বললেন, তোমরা আমার কবরকে পূজা করার উদ্দেশ্যে মূর্তিতে পরিণত করো না। [2]
এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদলার জন্যে নিজেকে পেশ করে বললেন, আমি যদি কারো পিঠে চাবুকের দ্বারা আঘাত করে থাকি তবে এই হচ্ছে আমার পিঠ সে যেন বদলা নিয়ে নেয়। যদি কাউকে অসম্মান করে থাকি তবে, সে যেন আমার কাছ থেকে বদলা গ্রহণ করে।
এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বরের ওপর থেকে নীচে নেমে এলেন এবং যোহরের নামায পড়ালেন। এরপর তিনি পুনরায় মিম্বরে উপবেশন করলেন এবং শত্রুতা ইত্যাদি সম্পর্কে বলা কথা পুনরায় বললেন। একজন লোক বললেন, আপনার কাছে আমি তিন দেরহাম পাওনা রয়েছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফযল ইবনে আব্বাস (রা.)- কে সেই ঋণ পরিশোধের আদেশ দিলেন। এরপর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনসারদের সম্পর্কে ওসিয়ত করলেন।
তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে আনসারদের ব্যাপারে ওসিয়ত করছি, কেননা তারা আমার অন্তরও কলিজা। তারা নিজেদের যিম্মাদারী পূর্ণ করেছে কিন্তু তাদের অধিকার সমূহ বাকি রয়ে গেছে। কাজেই তাদের মধ্যেকার নেককারদের গ্রহণ করবে এবং বদকারদের ক্ষমা করবে।
অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, তিনি বলেন, অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, তিনি বলেন, মানুষ বাড়তে থাকবে কিন্তু আনসারদের সংখ্যা কমতে থাকবে, এমনকি তারা খাবারের লবণের পরিমাণের মত হয়ে পড়বে। কাজেই তোমাদের মধ্যেকার যারা কোন লাভজনক বা ক্ষতিকর কাজের দায়িত্ব পাবে তারা আনসারদের মধ্যেকার নেককারদের গ্রহণ করবে এবং বদকারদের ক্ষমা করবে। [3]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর বরলেন, একজন বান্দাকে আল্লাহ তায়ালা এ এখতিয়ার দিয়েছেন যে, বান্দাহ ইচ্ছে করলে দুনিয়ার শান শওকত থেকে যা চাইবো আল্লাহ তায়ালা তাকে দেবেন অথবা আল্লাহর কাছে যা রয়েছে তা থেকে যা কিছু ইচ্ছা নিতে পারবে। সেই বান্দা আল্লাহর কাছে যা রয়েছে তা গ্রহণ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণানা করেণ যে, একথা শোনার পর হযরত আবু বকর ছিদ্দিক (রা.) কাঁদতে শুরু করলেন এবং আমি নিজের মা’বাপসহ আপনার ওপর কোরবান হচ্ছি।
একথা শুনে আমরা অবাক হলাম। লেকেরা বললো, এই বুড়োকে দেখো, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো একজন বান্দা সম্পর্কে বলছিলেন যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে এখতিয়ার দিয়েছেন তা থেকে যা ইচ্ছা গ্রহণ করতে পারে অথবা আল্লাহর কাছে যা রয়েছে তা থেকে যা ইচ্ছা গ্রহণ করতে পারে অথচ এই বুড়ো বলছে, আমি নিজের মা-বাপসহ আপনার ওপর কোরবান হচ্ছি।
কিন্তু কয়েকদিন পরেই এটা সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে, আল্লাহ তায়ালা যে বান্দাকে এখতিয়ার দিয়েছে তিনি ছিলেন স্বয়ং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সেদিন এটাও কারো বুঝতে বাকি থাকেনি যে, হযরত আবু বকর (রা.) হচ্ছেন আমাদের মধ্যেকার সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি। [4]
এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বন্ধুত্ব এবং অর্থ সম্পদের ত্যাগ স্বীকারে আমার প্রতি সবচেয়ে বেশী এহসানা যেন রয়েছে আবু বকরের। যদি আমি আমার প্রতিপালক ব্যতিত অন্য কাউকে খলিল/বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতাম, তবে আবু বকরকে গ্রহণ করতাম। কিন্তু তার সাথে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার সম্পর্ক বিদ্যমান। মসজিদে কোন দরজা খোলা রাখা না হয়, সকল দরজা যেন বন্ধ করা হয় শুধু আবু বকরের দরজা বন্ধ করা যাবে না। [5]
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের চারদিন আগে বৃহস্পতিবার, তিনি খুবিই কষ্ট পাচ্ছিলেন। সেই সময় তিনি বললেন, আমি তোমাদরে একটি লিখন লিখে দিচ্ছি, এরপর তোমরা কখনো গোমরাহ হবে না। সেই সময় ঘরে কয়েকজন লোক উপস্থি ছিলেন। তাদের মধ্যে হযরত ওমর (রা.)-ও ছিলেন। তিনি বললেন, আপনি অসুখে খুবই কষ্ট পাচ্ছেন এবং আমাদের কাছে পবিত্র কোরআন রয়েছে।
আমাদের জন্যে এই কেতাবই যথেষ্ট। একথা শুনে ঘরে উপস্থিত সাহাবদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিলো। কেউ কেউ বললেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা লিখে দিতে চাচ্ছিলেন, তা লিখিয়ে নেয়া হোক।
কেউ কেউ বলছিলেন, না দরকার নেই, হযরত ওমর (রা.) যা বলছেন, সেটাই ঠিক। মতভেদ এক সময়ে কথা কাটাকাটিতে পরিণত হলো এবং শোরগোল বেড়ে গেলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিরক্ত হয়ে বললেন, তোমরা আমার কাছ থেকে উঠে যাও। [6]
সেদিনই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনটি ব্যাপারে ওসিয়ত করলেন।
প্রথমত ইহুদি, নাসার এবং মোশরেকদের জাযিরাতুল আরব থেকে বের করে দেবে।
দ্বিতীয়ত আগন্তুক প্রতিনিধিদলের সাথে আমি যে রকম ব্যবহার করতাম সেই রকম ব্যবহার করবে।
তৃতীয় কথাটি বর্ণনাকারী ভূলে গেছেন, সম্ভবত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোরআন সুন্নাহ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা অথবা উসামা বাহিনীকে প্রেরণ করার কথা বলেছেন, অথবা তিনি বলেছিলেন, নামায এবং তোমাদের অধীনস্থ অর্থাৎ দাসদাসীদের প্রতি খেয়াল রাখবে।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অসুখের তীব্রতা সত্তেও ওফাতের চারদিন আগে অর্থাৎ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সকল নামাযে নিজেই ইমামতি করেন। সেদিনের মাগরিবের নামাযেও তিনি ইমামতি করেছিলেন।
এশার সময় রোগ এতো বেড়ে গেলো যে, মসজিদে যাওয়ার শক্তি রইল না। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, লোকেরা কি নামায আদায় করে ফেলেছে? আমরা বললাম, জ্বী না হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ওরা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামস বললেন, আমার জন্যে পাত্রে পানি লও।
আমরা তাই করলাম। তিনি গোসল করলেন। এরপর উঠতে চাইলেন কিন্তু বেহুঁশ হয়ে গেলেন। জ্ঞান ফিরে এলে জিজ্ঞাসা করলেন, লোকেরা কি নামায আদায় করে ফেলেছে? তাঁকে জানানো হল যে, জ্বী না হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ওরা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে। এরপর দ্বিতীয় এবং তৃতীয়বার একই অবস্থা হলো। তিনি গোসল করলেন এবপর উঠতে চাইলেন, কিন্তু বেহুঁশ হয়ে গেলেন।
এরপর তিনি হযরত আবু বকর (রা.)-কে খবর পাঠালেন, তিনি যেন নামায পড়িয়ে দেন। এরপর নবী করিমের অসুস্থতার অন্য দিনগুলোতেও হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা. নামায পড়ালেন। [8] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) সতের ওয়াক্ত নামাযে ইমামতি করেছিলেন। [7]
হযরত আয়েশা (রা.) তিন অথবা চারবার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এ মর্মে আরয করেন যে, ইমামতির দায়িত্ব হযরত আবু বকর (রা.) ব্যতিত অন্য কাউকে দেয়া হোক। তিনি ভাবছিলেন, লোকেরা হযরত আবু বকর ছিদ্কি (রা.) ব্যাপারে মন্দ ধারণ পোষণ না করুক। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিবারই সহধর্মিনীর আবেদন প্রত্যাখান করে বলেন, তোমরা সবাই ইউসুফ (আ,)-এর সাথীদের মত হয়ে গিয়েছো। [9]
আবু বকরকে আদেশ দাও তিন যেন নামায পড়ান।
শনি অথবা রোববার দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিছুটা সুস্থ বোধ করলেন। দু’জন লোকের কাঁধে ভর দিয়ে যোহরের নামাযের জন্যে মসজিদে গেলেন। সে সময় হযরত আবু বক র সিদ্দিক (রা.) সাহাবাদের নামায পড়াচ্ছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখে তিনি পেছনে সরে আসতে লাগলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইশারা করলেন যে পেছনে সরে আসার দরকার নেই।
যাদের কাঁধে ভর দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে এসেছিলেন তাদের বললেন, আমাকে আবু বকরের পাশে বসিয়ে দাও। এরপর তাঁকে হযরত আবু বকরের ডানপাশে বসিয়ে দেয়া হলো। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) তখন নামাযে নবী করিমের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একতেদা করছিলেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে তাকবির শোনাচ্ছিলেন। [10]
ওফাতের একদিন আগে রোবরাব দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সব দাস-দাসীকে মুক্ত করে দিলেন। তাঁর কাছে সে সময় সাত দিনার ছিলো, সদকা করলেন, তাঁর অস্ত্র-শস্ত্র মুসলমানদের হেবা করে দিলেন। রাতের বেলা চেরাগ জ্বালানোর জন্যে হযরত আয়েশা (রা.) এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে তেল ধার আনলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি বর্ম একজন ইহুদীর কাছে তিরিশ সাআ অর্থাৎ ৭৫ কিলো যবের বিনিময়ে বন্ধক ছিলো।
মহা জীবনের শেষ দিন:
হযরত আনাস (রা.) বলেন, সেদিন ছিলো সোমবার, মুসলমানর ফযরের নামায আদায় করছিলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ইমামতির দায়িত্বে ছিলেন। হঠাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লা হযরত আয়েশা সিদ্দিকার হুজরার পর্দা সরালেন এবং সাহাবাদের কাতারবাঁধা অবস্থায় নামায আদায় করতে দেখে মৃদু হাসলেন। এদিকে হযরত আবু বকর (রা.) কিছুটা পেছনে সরে গেলেন যেন নামাযের কাতারে রসূল শামিল হতে পারে।
তিনি ভেবেছিলেন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শামিল হতে পারেন এবং হয়তো নামাযে আসতে চান। হযরত আনাস (রা.) বলেন, হঠাৎ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখে সাহাবারা এতো আনন্দিত হলেন যে, নামাযের মধ্যেই ফেতানায় পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো অর্থাৎ তারা নামায ছেড়ে নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শারীকিক অবস্থার খবর নিতে চাচ্ছিলেন।
কিন্তু রসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাত দিয়ে সাহাবাদের ইশারা করলেন, তারা যেন নামায পুর করেন। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুজরার ভেতর চলে গেয়ে পর্দা ফেলে দিলেন।
এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অন্য কোন নামাযের সময় আসেনি। দিনের শুরুতে চাশত এর নামাযের সময়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রিয় কন্যা হযরত ফাতেমা (রা.)-কে কাছে ডেকে কানে কানে কিছু কথা বললেন। তা শুনে হযরত ফাতেমা যোহরা কাঁদতে লাগলেন। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুনরায় ফাতেমার কানে কিছু কথা বললেন, এবার হযরত ফাতেমা (রা.) হাসতে লাগলেন।
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, পরবর্তী সময়ে আমি হযরত ফাতেমাকে তাঁর কান্না ও হাসির কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, প্রথমবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, এই অসুখেই আমার মৃত্যু হবে। একথা শুনে আমি কাঁদলাম। এরপর তিনি আমাকে কানে কানে বললেন, আমার পরিবার-পরিজনের মধ্যে সর্ব প্রথম তুমিই আমার অনুসারী হয়ে পরলোকে যাবে। একথা শুনে আমি হাসলাম। [11]
সে সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যন্ত্রণার তীব্রতা থেকে হযরত ফাতেমা (রা.) হঠাৎ বলে ফেললেন, হায় আব্বাজানের কষ্ট। একথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমার আব্বার আজকের পর আর কোন কষ্ট নেই। [12]
নবী (স.) হযরত হাসান ও হোসেন (রা.) ডেকে চম্বুন করলেন এবং তাদের ব্যাপারে কল্যাণের ওসিয়ত করলেন। সহধর্মিনীদের ডাকলেন এবং তাদেরকেও ওয়ায-নসিহত করলেন।
এদিকে কষ্ট ক্রমেই বাড়ছিলো। বিষ-এর প্রভাবও প্রকাশ পাচ্ছিলো। খয়বরে তাঁকে এই বিষ খাওয়ানো হয়েছিলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়েশা (রা.)-কে বলতেন, হে আয়েশা খয়বরে আমি যে বিষ মিশ্রিত খাবার খেয়েছিলাম তার প্রতিক্রিয়ার কষ্ট সব সময় অনুভব করছি। এখন মনে হচ্ছে, সেই বিষের প্রভাব যেন আমার প্রাণের শিরা কাটা যাচ্ছে। [13]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহবায়ে কেরামের উদ্দেশ্যও ওসিয়ত করেন। তাদের তিনি বলেন, ‘আস সালাত, আস সালাত অমা মালাকাত আইমানুকুম। অর্থাৎ নামায নামায এবং তোমাদের অধীনস্থ দাসদাসী।’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথা কয়েকবার উচ্চারণ করলেন। [14]
মৃত্যুকালীন অবস্থা:
ওফাতকালীন অবস্থা শুরু হলো। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেহে ঠেস দিয়ে ধরে রাখলেন, তিনি বলেন, আল্লাহর একটি নেয়ামত আমার ওপর এই যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার ঘরে, আমার হিসেবের দিনে, আমার কোলের ওপর শেষ নিঃশাস ত্যাগ করেন। নবী সাল্লাল্লাহু্ আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওফাতের সময়ে আল্লাহ তায়ালা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এবং আমার থুথু একত্রিত করেন।
ঘটনা ছিলো এই যে, আবুদর রহমান ইবনে আবু বকর (রা.) এসছিলেন, সে সময় তার হাতে ছিল মেসওয়াক। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার গায়ের ওপর হেলান দেয়া অবস্থায় ছিলেন। আমি লক্ষ্য করপ্রলাম যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেসওয়াকের প্রতি তাকিয়ে আছেন। আমি বুঝলাম যে, তিনি মেসওয়া চান। বললাম আপনার জন্যে নেব কি?
তিনি মাথা নেড়ে ইশারা করলেন। আমি মেসওয়াক এনে তাঁকে দিলাম। কিন্তু শক্ত অনুভুত হলো। বললাম, আপনার জন্যে নরম করে দেবো? তিনি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। আমি দাঁত দিয়ে নরম করে দিলাম। এরপর তিনি বেশ ভালোভাবে মেসওয়াক করেন। তাঁর সামনে একটি পাত্রে পানি ছিলো।তিনি হাত ভিজিয়ে চেহারা মুছুছিলেন এবং বলছিলেন, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। মৃত্যু বড় কঠিন। [15]
মেসওয়াক শেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাত অথবা আঙ্গুল তুললেন। এ সময় তাঁর দৃষ্টি ছিলো ছাদের দিকে। উভয় ঠোঁট তখন নড়ছিলো। তিনি বিড় বিড় করে কি যেন বলছিলেন। হযরত আয়েশা (রা) মুখের কাছে কান পাতলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বলছিলেন, হে আল্লাহ তায়ালা। নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও সৎ ব্যক্তি যাদের তুমি পুরস্কৃত করেছ, আমাকে তাদের দলভূক্ত কর, আমাকে ক্ষমা করে দাও। হে আল্লাহ তায়ালা আমাকে মার্জনা করো, আমার ওপর রহম করো এবং আমাকে ‘রফিকে আলায়’ পৌছে দাও। হে আল্লাহ তায়ালা! রফিকে আলা ! [16]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষ কথাটি তিনবার উচ্চারণ করেন। এর পরপরই তাঁর হাত ঝুঁকে পড়লো এবং তিনি পরম প্রিয়ের সান্বিদ্ধে চলে গেলেন। ‘ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।’ অর্থাৎ আমরা সবাই আল্লাহর জন্যে এবং তাঁর কাছেই আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে।
এ ঘটনা ঘটেছিলো একাদশ হিজরীর ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার চাশত এর নামাযের শেষ সময়ে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বয়স ছিলো তখন তেষট্টি বছর চারদিন।
দাফনের প্রস্তুতি:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দাফনের জন্যে কাফন পরানোর আগেই তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনয়নের প্রশ্নে সাহাবাদের মধ্যে কিছুটা মতবিরোধে দেখা দিলো। ছাকিফা বনি সাআদায় মোহাজের ও আনসারদের মধ্যে বাদানুবাদ হলো। অবশেষে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর খেলাফতের ব্যাপারে সাবই একমত হলেন। একাজে সোমবারের বাকি দিন কেটে গেলো। রাত এসে গেলো।
সবাই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পরদিন সকাল হলো, সেদিন ছিলো মঙ্গলবার। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র দেহ সেই ইয়েমেনী চাদরে আবৃত ছিলো। ঘরের লোকেরা ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
পরদিন মঙ্গলবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেহ অনাবৃত না করেই তাঁকে গোসল দেয়া হলো। যারা গোসল করিয়েছিলেন তারা হলেন হযরত আব্বাস, হযরত আলী, হযরত আব্বাসের দুই পুত্র ফযল এবং ছাকাম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মুক্ত করে দেয়া দাস শাকরান, হযরত উসামা ইবনে যায়েদ এবং আওস ইবনে খাওলা (রা.)।
হযরত আব্বাস ও তাঁর দুই পুত্র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাশ ফেরাচ্ছিলেন। হযরত উসামা এবং হযরত শাকরান পানি ঢেলে দিচ্ছিলেন। হযরত আলী (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গোসল দিচ্ছিলেন। হযরত আওস (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিজের বুকের সাথে চেপে রাখছিলেন।
গোসল দেয়ার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তিনখানি ইয়েমেনী সাদা চাদর দিয়ে কাফন দেয়া হয়। এতে কোর্তা এবং পাগড়ি ছিলো না। [17]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শুধু চাদর দিয়েই জড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কোথায় দাফন করা হবে, সে সম্পর্কেও সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, সকল নবীকেই যেখানে তুলে নেয়া হয়েছে, সেই জায়গায় দাফন করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত, হওয়ার পর হযরত আবু তালহা (রা.) সেই বিছানা ওঠালেন, যে বিছানায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করেন। সেই বিছানার নীচে কবর খনন করা হয়।
এরপর দশজন দশজন করে সাহাবা হুজরায় প্রবেশ করে পর্যায়ক্রমে জানাযার নামায আদায় করেন। এ নামাযে কেউ ইমাম হননি। সর্বপ্রথম বনু হাশেম গোত্রের লোকেরা নামায আদায় করেন। এরপর মোহজের এরপর আনসাররা, এরপর অন্যান্য পুরুষ এরপর মহিলা, এবং সবশেষে শিশুরা জানাযার নামায আদায় করেন।
জানাযার নামায আদায়ে মঙ্লবার পুরো দিন অতিবাহিত হয়। মঙ্লবার দিবাগত রাত্রে প্রিয় নবী মোহাম্মদ মোস্তফা আহমদ মুজতবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দাফন করা হয়। তাঁর পবিত্র দেহ কবরের ভেতর রাখা হয়।
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঠিক কখন দাফন করা হয় আমরা জানতে পারিনি। তবে বুধবার রাতের মাঝামাঝি সময়ে কিছু শব্দ পেয়েছিলাম। [18]
মোহাম্মদ তো রসূল ছাড়া কিছুই নয়, তার আগেও বহু রসূল গত হয়ে গেছে। সে যদি মরে যায় অথবা তাকে যদি কেউ মেরে ফেলে, তাহলে কি (তার আদর্শ থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেবে? (জেনে রেখো) যে ব্যক্তিই (এভাবে) মুখ ফিরিয়ে নেয় সে আল্লাহর কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। (সূরাঃ আল ইমরান-১৪৪)
ফুটনোট:
[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৫২, মুয়াত্তা ইমাম মালেক, পৃ-৩৬০]
[মুয়াত্তা ইমাম মালেক, পৃ-৬৫]
[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৫২৬]
[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৫৩৬]
[বোখারী,মুসলিম, প্রথম খন্ড, পৃ-৫১৬, মেশকাত দ্বিতীয় খন্ড, পৃ-৫৪৬-৫৫৪]
[বোখারী ও মুসলিম, বোখারী ১ম খন্ড, পৃ-২২,৪২৭, ২য় খন্ড, পৃ-৬৩৮]
[বোখারী ও মুসলিম। মেশকাত প্রথম খন্ড, পৃ-১০২]
[বোখারী ও মুসলিম। মেশকাত ১ম খন্ড, পৃ-১০২]
[হযরত ইউসুফ (আ.)-এর ঘটনায় যে সকল মহিলা আজিজ মেছেরের স্ত্রীকে অভিযুক্ত করছিল তারা দৃশ্যত এরূপ করছিল কিন্তু হযরত ইউসুফকে দেখে যখন তারা আঙ্গুল কেটে ফেলল তখন বোঝা গেল যে, ওরা সবাই হযরত ইউসুফ (আ.)-এর প্রতি নিবেদিত প্রাণ। অর্থাৎ তাদের মুখে এক মনে এক । এখানেও অবস্থা সেরকম। দৃশ্যত বলা হচ্ছির যে, হযরত আবু বকর সিদ্দিকের মন নরম,আপনার জায়গায় দাঁড়িয়ে নামায পড়াতে শুরু করলে কান্নার প্রকোপে কেরাত পাঠ করতে পারবে না।
কিন্তু মনে মনে ঠিকই একথা ছিল যে, যদি খোদা না করুন রসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করেন তাহলে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-সম্পর্কে সবাই মন্দ ধারণ পোষণ করবে এবং তাকে অপয়া বলে অপবাদ দেবে। এসব কারণে হযরত আয়েশা সিদ্দিকার আবেদনের সাথে অন্যান্য নবী সহধর্মিনীরাও নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে একই আবেদন জানান। এ কারণে নবী (স.) বলেন যে, তোমরা সবাই হচ্ছো নবী ইউসুফের ভাইদের মতো।]
[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৯৮-৯৯]
[বোখারী ২য় খন্ড, পৃ-৬৩৮]
[কোন কোন বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, আলোচনা এবং সুসংবাদ দেয়ার এ ঘটনা নবী জীবনের শেষ দিনে নয় বরং শেষ সপ্তাহে ঘটেছিল। দেখুন রহমতুল লিল আলামীন, ১ম খন্ড,পৃ-২৮২]
[সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৬৩৭]
[সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৬৩৭]
[সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৬৪০]
[সহীহ বোখারী, মরযে নবী অধ্যায় এবং নবী জীবনের শেষ কথা অধ্যায়, ২য় খন্ড, পৃ-৬৩৮-৬৪১]
[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-১৬৯, সহীহ মুসলিম ১ম খন্ড, পৃ-৩০৬]
[শেখ আব্দুল্লাহ রচিত মুখতাছার সীরাতে রসূল পৃ-৪৭১, এ ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দেখুন বোখারী শরীফের মরজুন নবী অধ্যায়। আরো দেখুন ফতহুল বারী, সহীহ মুসলিম, মেশকাত। এছাড়া ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ-৬৪৯-৬৬৫, তালকীহ, পৃ-৩৮-৩৯, রহমতুল লিল আলামীন ১ম খন্ড,পৃ-২৭৭-২৮৬]
বিদায় হজ্জ
★★★ দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ পূর্ণ হয়েছে। আল্লাহর রবুবিয়ত এবং অন্য সকল মতাদর্শের বিলোপ সাধন করে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেন রেসালতের ভিত্তিতে একটি নতুন সমাজ গঠন করা হয়েছে। এরপর যেন অদৃশ্য ঘোষক রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চিন্ত ও চেতনার এ ধারণা বদ্ধমূল করেছিলো যে, পথিবীতে তাঁর অবস্থানের মেয়াদ শেষ হয়ে এসেছে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মায়া’য (রা.)-কে ইয়েমেনের গভর্নর নিযুক্ত করে প্রেরণ করার সময় অন্যান্য প্রয়োজনীয় কথার পর বললেন, হে মায়া’য সম্ভবত এই বছরের পর আমার সাথে তোমার আর সাক্ষাৎ আর হবে না। হয়তো এরপর তুমি আমার মসজিদ এবং কবরের কাছে দিয়ে অতিক্রম করবে। হযরত মায়া’য (রা.) একথা শুনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চিরবিদায়ের কথা ভেবে কাঁদতে শুরু করলেন।
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালা চাচ্ছিলেন যে, তাঁর রসূলকে দীর্ঘ বিশ বছরের দুঃখ-কষ্ট ও নির্যাতনের সুফল প্রত্যক্ষ করাবেন। হজ্জের সময় মক্কার বিভিন্ন এলাকা থেকে জনসাধারণ এবং জন প্রতিনিধিদলল মক্কায় সমবেত হবেন এরপর তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে শরীয়তের বিধি-বিধান সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছ থেকে এ মর্মে সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন যে, আমি আমার ওপর অর্পিত আমানত পূর্ণ করেছি, আল্লাহর পয়গাম মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছি এবং উম্মতের কল্যাণের হক আদায় করেছি।
আল্লাহর এইরূপ ইচ্ছা অনুযায়ী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে ঐতিহাসিক হজ্জের তারিখ ঘোষণা করলেন তখন নির্দিষ্ট দিনে দলে দলে মুসলমান মক্কায় পৌঁছুতে শুরু করলেন। সমবেত সকলেই মনে-প্রাণে চাচ্ছিলেন যে, তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ গ্রহণ করে তাঁর আনুগত্য মেনে নেবেন। [1]
অতপর শনিবার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কার পথে রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। যিলকদ মাসের তখনো চারদিন বাকি ছিলো। [2]
তিনি মাথায় তেল দিলেন, চুল আঁচড়ালেন. তহবন্দ পরেলেন,চাদর গায়ে জড়ালেন, কোরবানীর পশুকে সজ্জিত করলেন এবং যোহরের পর রওয়ানা হলেন। আছরের আগেই তিনি যল হুলাইফা নামক জায়গায় পৌঁছুলেন। সেখানে আছরের দুই রাকাত নামায আদায় করলেন। রাত যাপনের জন্যে তাঁবু স্থাপন করলেন। সেখানে রাত কাটালেন। সকালে তিনি সাহাবাদের বললেন, রাতে আমার পরওয়াদেগারের কাছ থেকে একজন আগন্তুক এসে বলেছে, হে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই পবিত্র প্রান্তরে নামায আদায় করুন এবং বলুন যে, হজ্জের মধ্যে ওমরাহ রয়েছে। [3]
এরপর যোহর নামাযের আগে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এহরামের জন্যে গোসল করলেন। হযরত আয়েশ (রা.) নিজ হাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র দেহে জারিরা ও মেশক খুশবু লাগালেন। খুশবুর চমক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সিথি এবং পবিত্র দাড়িতে দেখা যাচ্ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই খুশবু ধৌত করেননি। যেমন ছিলো তেমনই রেখে দিলেন।
এরপর তিনি তহবন্দ চাদর পরিধান করলেন। যোহরের দুই রাকাত নামায আদায় করলেন। পরে মোসল্লায় বসেই হজ্জ এবং ওমরাহর একত্রে এহরাম বেঁধে লাব্বায়েক আওয়াজ দিয়ে বাইরে এলেন। পরে উটনীতে আরোহণ করে দু’বার লাব্বায়েক বললেন। উটনীতে চড়ে খোলা ময়দানে গিয়ে সেখানেও লাব্বায়েক ধ্বনি দিলেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর তাঁর সফর অব্যাহত রাখলেন। এক সপ্তাহ পর তিনি এক বিকেলে মক্কার কাছে পৌঁছে যি-তুবা নামক জায়গায় অবস্থান করলেন এবং ফজরের নামায আদয়ের পর গোসল করলেন। এরপর মক্কায় প্রবেশ করলেন। সেদিন ছিলে দশম হিজরীর যিলহজ্জ মাসের চার তারিখ রোববার। মদীনা থেকে রওয়ানা হওয়ার পর পথে আট রাত অতিবাহিত হয়েছিলো।
স্বাভাবিক গতিতে পথ চললে এরূপ সময়ই প্রয়োজন হয়। মসজিদে হারামে পৌঁছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথমে কাবাঘর তওয়াফ করেন। এরপর সাফা মারওয়ার মধ্যবর্তী জায়গায় সাঈ করেন। কিন্তু এহরাম খোলেননি। কেননা তিনি হজ্জ ও ওমরাহর এহরাম একত্রে বেঁধেছিলেন।
নিজের সাথে কোরবানীর পশুও নিয়ে এনেছিলেন। তওয়াফ এবং সাঈ শেষে তিনি মক্কার হাজ্জন নামক স্থানে অবস্থান করেন। কিন্তু দ্বিয়ীয় হজ্জের তওয়াফ ছাড়া কোন তওয়াফ করেননি।
যিলহজ্জ মাসের আট তারিখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিনায় গমন করলেন। সেখানে ৯ই যিলহজ্জ তারিখ পর্যন্ত অবস্থান করলেন। যোহর, আছর, মাগরিব, এশা এবং ফযর এই পাঁচ ওয়াক্ত নামায সেখানে আদায় করে সেখানে সূর্যোদয় পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। পরে আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। সেখানে পৌঁছে দেখে নেমরাহ প্রান্তরে তাঁবু প্রস্তুত রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে উপবেশন কররলেন। সূর্য ঢলে পড়লে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশ উটনীর পিঠে আসন লাগানো হলো।
তিনি প্রান্তরের মাঝামাঝি স্থানে গমন করলেন। সেই সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চারিদিকে এক লাখ চব্বিশ হাজার মতান্তরে এক লাখ চুয়াল্লিশ হাজার মানুষের সমুদ্র বিদ্যামন ছিলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জেসমবেত জনসমুদ্রের উদ্দেশে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন।
তিনি বলেন,‘ হে লোক সকল, আমার কথা শোনো, আমার কথা শোনো, আমি জানি না, এবারের পর তোমাদের সাথে এই জায়গায় আর মিলিত হতে পারবো কি না।’ [4]
তোমাদের রক্ত এবং ধন-সম্পদ পরস্পরের জন্যে আজকের দিন, বর্তমান মাস এবং বর্তমান শহরের মতোই নিষিদ্ধ। শোনো, জাহেলিয়াতের সময়ের সবকিছু আমার পদতলে পিষ্ট করা হয়েছে। জাহেলিয়াতের খুন ও খতম করে দেয়া হয়েছে। আমাদের মধ্যেকার যে প্রথম রক্ত আমি শেষ করছি তা হচ্ছে, রবিয় ইবনে হারেসের পুত্রের রক্ত।
এই শিশু বনি সা’দ গোত্রে দুধ পান করছিলো সেই সময়ে হোযাইল গোত্রের লেকেরা তাকে হত্যা করে। জাহেলী যুগের সুদ খতম করে দেয়া হয়েছে। আমাদের মধ্যকার প্রথম যে সুদ আমি খতম করছি তা হচ্ছে আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালেবের সুদ। এখন থেকে সকল প্রকার সুদ শেষ করে দেয়া হলো।
মেয়েদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো, কেননা তোমরা তাদেরকে আল্লাহর আামনতের সাথে গ্রহণ করেছে এবং আল্লহর কালেমার মাধ্যমে হালাল করেছ। তাদের ওপর তোমাদের অধিকার রয়েছে যে, তারা তোমাদের বিছানায় এমন কাউকে আসতে দেবে না যাদের তোমরা পছন্দ করো না। যদি তারা এরূপ করে তবে তোমারা তাদের প্রহার করতে পারো। কিন্তু বেশী কঠোরভাবে প্রহার করো না। তোমদের ওপর তাদের অধিকার হচ্ছে এই যে, তোমরা তাদের ভালোভাবে পানাহার করাবে এবং পোশাক দেবে।
তোমাদের কাছে আমি এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি যে, যদি তোমর তা দৃঢ়ভাবে ধারন করে থাকো তবে এরপর কখানো পথভ্রষ্ট হবে না। সেই জিনিস হচ্ছে আল্লাহর কেতাব। [5]
হে লোক সকল মনে রেখো আমার পরে কোন নবী নেই। তোমদের পরে কোন উম্মত নেই। কাজেই নিজ প্রতিপালকের এবাদত করবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করবে। রমযান মাসে রোযা রাখবে। সানন্দ চিত্তে নিজের ধন-সম্পদের যাকাত দেবে। নিজ পরওয়ারদেগারের ঘরে হজ্জ করবে। নিজের শাককদের আনুগত্য করবে। যদি এরূপ করো তবে তোমাদের পরওয়ারদেগারের জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। [6]
তোমাদরে সাথে আমার সম্পর্কের ব্যাপারে তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে। তোমরা তথন কি বলবে? সাহবারা বললেন, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি তাবলীগ করেছেন, পয়গাম পৌঁছে দিয়েছেন। কল্যাণকারিতার ব্যাপারে ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করেছেন।
একথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাহাদাত আঙ্গুল আকাশের দিকে তুলে এরপর লোকদের দিকে ঝুঁকিয়ে তিনবার বললেন, ইয়া রাব্বুল আলামীন, তুমি সাক্ষী থেকো। [7]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বানীসমূহ রবিয়া ইবনে উামইয়া ইবনে খালফ উচ্চকন্ঠে মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছিলেন। [8]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভাষণ শেষ করার পর আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের এই আয়াত নাযিল করেন।
‘আজ তোমদের জন্যে তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদরে দ্বীন মনোনীত করলাম।’(সূরা মায়েদা,আয়াত -৩)
হযরত ওমর (রা.) এই আয়াত শুনে কাঁদতে শুরু করেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি বলেন, কাঁদছি এ জন্যে যে, পূর্ণতার পর অপূর্ণতাই শুধু বাকি থাকে। [9]
নবী করিমের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভাষণের হযরত বেলাল (রা.) আযান ও একামত দিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যোহরের নামাজ পড়ালেন। এরপর হযরত বেলাল একামত দিলেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আছরের নামাজ পড়ালেন। সেখানে তিনি উটনীর পিঠেই অপেক্ষা করলেন, কিছুক্ষণ পর সূর্যাস্ত হলো।
এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত উসামাকে (রা.) পেছনে বসালেন এবং সেখানে থেকে রওয়ান হয়ে মোযদালেফা গমন করলেন। সেখানে মাগরেব ও এশার নামায এক আযানের দুই একামতে আদায় করলেন। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলাইহি ওয়া সাল্লাম শয়ন করলেন।
ফজরের নামাযের সময় হওয়া পর্যন্ত তিনি শায়িত থাকলেন। ফজরের সময় হওয়ার পর আযান ও একামতের সাথে ফজরের নামায আদায় করলেন। এরপর উটনীতে সওয়ার হয়ে ‘মাশআরে হারামে’ গমন করে কেবলার দিকে ফিরে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। আল্লাহর নামে তাকবীর ধ্বনি দিলেন এবং তওহীদের কালেমা উচ্চারণ করলেন। সেখানে সকালে চারিদকে ভালোভাবে ফর্সা হওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করলেন। এরপর সূর্য ওঠার আগে আগেই মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। এবার হযরত ফযল ইবনে আব্বাসকে নিজের পেছনে বসালেন।
‘বাৎনে মোহচ্ছার’ (আবরাহার সৈন্যদের ওপর গযব আসার জায়গায়) পৌঁছে সওয়ারীকে জোর ছোটালেন। জামরায়ে কোবরার পথে রওানা হয়ে সেখানে পৌঁছুলেন। এর পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে সাতটি পাথর নিক্ষেপ করেন। প্রতিবারের পাথর নিক্ষেপের সময় তিনি তাকবির ধ্বনি দিচ্ছিলেন। ছোট ছোট পাথরের টুকরো ছিলো সেগুলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে এসব পাথর নিক্ষেপ করেন।
এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বধ্যভূমিতে গমন করে তাঁর পবিত্র হাতে ৬৩টি উট যবাই করেন। এরপর বাকি ৩৭টি উট হযরত আলী (রা.)-কে যবাই করতে দেয়া হয়। এভাবে একশত উট কোরবানী করা হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলীকেও তাঁর কোরবানীর মধ্যে শামিল করে নেন।
তাঁর আদেশে প্রত্যেক উট থেকে এক টুকরো করে গোশত নিয়ে একটি হাড়িতে রান্না করা হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত আলী সেই গোশত কিছু আহার করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিছু সুরুয়াও পান করেন।
এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সওয়ারীতে আরোহণ করে মক্কা মোয়াযযমায় গমন করলেন। বায়তুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করলেন। এই তওয়াফকে বলা হয় তওয়াফে এফাযা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় যোহরের নামায আদায় করলেন। যমযক কূপের কাছে বনু আবদুল মোত্তালেবের কাছে গমন করলেন। তারা হাজীদের যমযমের পানি পান করাচ্ছিলেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে বনু আবদুল মোত্তালেব তোমরা পানি উত্তোলন করো। যদি এ আশঙ্কা পোষণ না করতাম যে পানি উত্তোলনের কাজে অন্য লোকেরা তোমাদরে পরাজিত করে দেবে তবে আমিও তোমাদরে সাথে পানি উত্তোলন করতাম। অর্থাৎ সাহাবারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পানি তুলতে দেখলে সবাই পানি তোলার জন্যে চেষ্টা করবেন।
এর ফলে হাজীদের পানি পান করানোর যে গৌরব এককভাবে বনু আবদুল মোত্তালেবের রয়েছে তা আর থাকবে না। অতপর বনু আবদুল মোত্তালেবের লোকেরা নবী (রা.)-কে এক বালতি পানি দিল এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই পানি প্রয়োজন মতো পান করলেন। [10]
এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আইয়ামে তাশরীক অর্থাৎ ১১,১২, ও ১৩ই যিলহজ্জ তারিখে মিনায় অবস্থান করেন। এই সময়ে তিনি হজ্জের রীতিসমূহও পালন করছিলেন। সেই সাথে জনসাধারণকে শরীয়তের হুকুম-আহকাম ও শিক্ষা দিচ্ছিলেন। আল্লাহর যেকেরও করছিলেন। মিল্লাতে ইবরাহীমের সুন্নতসমূহেও কায়েম করছিলেন। শেরেকের নিদর্শনসমূহ নির্মূল করছিলেন।
সর্বশেষ সামরিক অভিযান:
সুবিস্তৃত রোমক সাম্রাজ্যের শাসকবর্গ ইসলাম এবং ইসলাম গ্রহণকারীদের বেঁচে থাকার অধিকার মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলো না। এ কারণে রোমক সাম্রাজ্যের নিয়নিন্ত্রত এলাকার কারো ইসলাম গ্রহণ করা ছিলো বিপজ্জনক। রোমক সাম্রাজের শসকদের ঔদ্ধত্য এবং অহঙ্কারপূর্ণ আচরণের প্রেক্ষিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একাদশ হিজরীর সফর মাসে এক বিরাট বাহিনী তৈরীর কাজ শুর করলেন।
হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রা.)-কে সেই বাহিনীর সিপাহসালার নিযুক্ত করে তিনি আদেশ দিনলেন যে, বালকা এলাকা এবং দারুমের ফিলিস্তিনি ভূখন্ড সওয়ারদের মাধ্যমে নাস্তানাবুদ করে এসো। রোমকদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে করে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বসবাসকারী আরব গোত্রসমূহের মনে সাহস সঞ্চার করাই ছিলো এ পদক্ষেপের উদ্দেশ্য। এর ফলে কেউ একথা ভাবতে পারবে না যে, গীর্জার বাড়াবাড়ি ও স্বেচ্ছাচারিতার সামনে কথা বলার কেউ নেই। তাছাড়া একথাও কেউ মনে করতে পারবে না যে, ইসলাম গ্রহণ করার অর্থ হচ্ছে নিজের মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানানো।
হযরত উসামা (রা.)-কে সেনাপতি নিযুক্ত করার কেউ কেউ সমালোচনা করে এ অভিযানের প্রস্তুতিও অংশগ্রহণে ইতস্তত করলেন। এ অবস্থা করে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা যদি উসামার সেনাপতিত্বের প্রশ্নে সমালোচনা মুখর হও তবে তো বলতেই হয় যে, ইতিপূর্বে তার পিতাকে সেনাপতি নিযুক্ত করায় তোমরা সমালোচনা মুখর হয়েছিলো।
অথচ আল্লাহর শপথ, যায়েদ ছিলো সেনাপতি হওয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন। এছাড়া সে ছিলো আমার প্রিয় ভাজনদের অন্যতম। উসামাও যায়েদের পর আমার প্রিয় ভাজনদের অন্যতম। [11]
তখন সাহাবায়ে কেরাম (রা.) হযরত উসামা (রা.)-এর আশপাশে সমবেত হয়ে তার সেনাবাহিনীতে শামিল হলেন। এই সেনাবাহিনী রওয়ানা হয়ে মদীনা থেকে তিন মাইল দূরে মাকামে যরফ নামক স্থানে গ্রহণ করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসুখ সম্পর্কে উদ্বেগজনক খবর পেতে থাকায় তারা সামনে অগ্রসর হননি। আল্লাহর ফয়সালার অপেক্ষায় তারা সেখানেই অপেক্ষা করতে লাগলেন। আল্লাহর ফয়সালা ছিলো এই যে, হযরত আবু বরক ছিদ্দিক (রা.)-এর খেলাফতের প্রথম সামরিক অভিযান হিসাবে এটি আখ্যায়িত হবে। [12]
ফুটনোট:
[এই হাদীস সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে। দ্রষ্টব্য প্রথম খন্ড,পৃ=৩৯৪, হুজ্জাতুল নবী অধ্যায়।]
[হাফেজ ইবনে হাজর এ ব্যাপারে চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন। কোন কোন বর্ণনায় জিলকদ মাসের ৫ দিন বাকি থাকার যে কথা রয়েছে তা সংশোধন করেছেন।দ্রষ্টব্য ফতহুল বারী, ৮ম খন্ড, পৃ-২০৭।]
[রোখারী শরীফে হযরত ওমর (রা.) থেকে এই বর্ণনা সঙ্কলিত হয়েছে। ১ম খন্ড, পৃ-২০৭]
[ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড,পৃ-৬০৩]
[সহীহ মুসলিম, হুজ্জতুল নবী অধ্যায়।১ম খন্ড, পৃ-৩৯৭]
[ইবনে মাজা, ইবনে আসাকের, রহমতুল লিল আলমিন,১ম খন্ড, পৃ-২৬৩]
[সহীহ মুসরিম, ১ম খন্ড, পৃ-৩৯৭]
[ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ-৬০৫]
[বোখারী, ইবনে ওমরের (রা.) বর্ণনা দ্রষ্টব্য। ১ম খন্ড, পৃ-২৬৫]
[মুসলিম শরীফে ও হযরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে। হুজ্জাতুন নবী অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ-৩৯৭-৪০০]
[সহীহ বোখারী, উসামাকে প্রেরণ অধ্যায়, উসামা ২য় খন্ড, পৃ-৬১২]
[সহীহ বোখারী, এবং ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ-৬০৬-৬৫০]।
তাবুক এর যুদ্ধ
★★★ যুদ্ধের কারণ ওই সময়ে এমন একটি শক্তি মদীনার প্রতি দৃষ্টি দিয়েছিলো, যারা কোন প্রকার উস্কানি ছাড়াই মুসলামনদের গায়ে বিবাদ বাধাতে চাচ্ছিলো। এরা ছিলো রোমক শক্তি। সমকালীন বিশ্বে এরা ছিলো সর্ববৃহৎ ও শ্রেষ্ঠ শক্তি। ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ বিবাদের ভূমিকা তৈরী হয়েছিলো শেরহাবিল ইবনে আমর গাস্সানির হাতে।
এই ব্যক্তি নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দূত হারেস ইবনে আযদিকে হত্যা করেছিলো। মূতার যুদ্ধের পর এক বছর যেতে না যেতেই কায়েসারে রোম, রোমের অধিবাসী এবং রোমের অধীনস্ত আরব এলাকাসমূহ থেকে সৈন্য সমাবেশ শুরু করলেন। এটা ছিলো মুসলমানদের সাথে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পূর্ব প্রস্তুতি।
রোম ও গাসসানের প্রস্তুতির খবর এদিকে মদীনায় পর্যায়ক্রমে খবর আসছিলো যে, রোমে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক সিদ্ধান্তমূলম যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। এ খবর পেয়ে মুসলমানরা অস্বস্তি এবং উৎকন্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। হঠাৎ কোন শব্দ শুনলেই তারা চমকে উঠতেন। তারা ভাবতেন, রোমকরা বুঝি এসে পড়েছে। নবম হিজরীতেস একটি ঘটনা ঘটলো। এ ঘটনা থেকেই মুসলমানদের উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার পরিচয় যায়। [1]
এ সময়ে সিরিয়া থেকে তেল আনতে যাওয়া নাবেতিদের ৪ [এরা নাবেত ইবনে ইসমাইল (আ.)-এর বংশধর। এক সময় এরা পাটরা এবং হেজাযের উত্তরাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেছিলে। কিন্তু কালক্রমে শক্তিহীন হয়ে কৃষক ও ব্যবসায়ীতে হয় পরিণত হয়] কাছে হঠাৎ জানা গেলো যে, হিরাক্লিয়াস ৪০ হাজার দুর্ধর্ষ সৈন্যের এক বহিনী তৈরী করেছেন এবং রোমের এক বিখ্যাত যোদ্ধা সেই সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব করছেন।
সেই কমান্ডার তার অধীনে খৃষ্টান গোত্র লাখাম জাযাম প্রভৃতিকে সমভেত করেছে এবং অগ্রবর্তী বাহনিী বালকা নামক জায়গায় পৌঁছে গেছে। এমনিভাবে এক গুরুতর সমস্যা মুসলমানদের সামনে দেখা দিলো ।
সেই সময় প্রচন্ড গরম পড়েছিলো। দেশে অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা এবং দুর্ভিক্ষপ্রায় অবস্থা বিরাজ করছিলো। এ কারণে অনেকেই ছায়ায় এবং ফলের কাছাকছি থাকতে চাচ্ছিলো। তারা তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধ যেতে চাচ্ছিলেন না। তদুপরি পথের দূরত্ব ছিলো, পথ ছিলো দুর্গম ও বন্ধুর। সব কিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি ছিলো বড়োই নাযুক।
আল্লাহর নবী এ পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, এমন সঙ্কট সময়ে যদি রোমকদের সাথে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে শৈথিল্য ও অলসতার পরিচয় দেয়া হয় তাহলে রোমকরা মুসলিম অধিকৃত ও অধ্যুষিত এলাকাসমূহে প্রবেশ করবে।
ফলে ইসলামের দাওয়াত, প্রচার এবং প্রসারে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। মুসলমানরা সামরিক শক্তির স্বাতন্ত্র হারাবে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, মুসলিম অধিকৃত ও অধ্যুষিত এলাকায় বিধর্মীদের প্রবেশের সুযোগ দেয়ার তো দূরে থাক বরং ওদের এলাকায় গিয়েই আঘাত করা হবে।
রোমকদের সাথে যুদ্ধ প্রস্তুতির ঘোষণা:
উল্লিখিত বিষয়সমূহ পর্যালোচনার পর নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের মধ্যে যুদ্ধ প্রস্তুতির নির্দেশ দিলেন। মক্কাবাসী এবং আরবের বিভিন্ন গোত্রকেও যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হলো। অন্য সময়ে নবী শ্রেষ্ঠ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধের ক্ষেত্রে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতেন গন্তব্যের কথা গোপন রাখতেন। কিন্তু এবার তা করলেন না।
প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন যে, রোমকদের সাথে যুদ্ধ হবে। মুসলমানরা যেন যুদ্ধের জন্যে ভালোভাবে প্রস্তুত হতে পারেন। এ জন্যেই প্রকাশ্যে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো। যুদ্ধের জন্যে মুসলামনদের প্রস্তুতিতে উদ্ধুদ্ধ করতে সূরা তাওবার একাংশও নাযিল হয়েছিলো। সাথে সথে তিনি সদকা খয়রাত করার ফযিরত বর্ণনা করেন এবং আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয়ে মুসলমানদের অনুপ্রাণিত করেন।
যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্যে মুসলামনদের প্রচেষ্টা:
সাহাবায়ে কেরাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ পাওয়ার পরই যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি শুরু করেন। মদীনার চারিদিক থেকে আগ্রহী মুসলমানরা আসতে থাকেন। যাদের মনে মোনাফেকী অর্থাৎ নেফাকের অসুখ রয়েছে, তারা ছাড়া কেউ এ যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার কথা ভাবতেই পারেননি। তবে তিন শ্রেণীর মুসলামন ছিলেন পৃথক।
তাদের ঈমান ও আমলে কোন প্রকার ত্রুটি ছিলো না। গরীব ক্ষুধাতুর মুসলামনরা আসছিলেন এবং যানবাহনের ব্যবস্থা করার আবেদন জানাচ্ছিলেন। কিন্তু রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অক্ষমতা প্রকাশ করছিলেন। সূরা তাওবায় এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
‘ওদের কোন অপরাধ নেই, যারা তোমার কাছে বহনের জন্যে এলে তুমি বলেছিলে, ‘তোমাদের জন্যে কোন বাহন আমি পাচ্ছি না। ওরা অর্থ ব্যয়ে অসামর্থতাজনিত দুঃখে অশ্রু বিগলিত চোখে ফিরে গেলো।’
মুসলমানরা সদকা-খয়রাতের দিক থেকে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন । হযরত ওসমান (রা.) সিরিয়ায় ব্যবসার জন্যে প্রেরণের উদ্দেশ্যে একটি কাফেলা তৈরী করেছিলেন। এতে সুসজ্জিত দুইশত উট ছিলো। দুশো উকিয়া অর্থাৎ প্রায় সাড়ে উনত্রিশ কিলো রৌপ্য ছিলো তিনি এইসবই সদকা করে দিলেন। এরপর পুনরায় একশত উট সুসজ্জিত অবস্থায় দান করলেন।
তিনি এক হাজার দীনার অর্থাৎ প্রায় ৫ কিলো সোনা নিয়ে এলেন এবং তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেসব উল্টেপাল্টে দেখছিলেন আর বলছিলেন, আজকের পর থেকে ওসমান যা কিছুই করুক না কেন, তার কোন ক্ষতি হবে না। [2]
এরপরও হযরত ওসমান (রা.) সদকা করেন। সব মিলিয়ে দেখা গেলো যে, তাঁর সদকার পরিমাণ নগদ অর্থ ছাড়াও ছিলো নয়শত উট এবং একশত ঘোড়া।
এদিকে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) দু’শো উকিয়া অর্থাৎ প্রায় সাড়ে উনত্রিশ কিলো চাঁদি নিয়ে আসেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) তাঁর ঘরের সবকিছু নিয়ে আসেন এবং ঘরে শুধু আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলকে রেখে আসেন। তাঁর সদকার পরিমাণ ছিলো চার হাজার দিরহাম। তিনিই প্রথমে তার সদকা নিয়ে হাযির হয়েছিলেন। হযরত ওমর (রা.) তার অর্ধেক ধন-সম্পদ নিয়ে হাযির হন।
হযরত আব্বাস (রা.) তাঁর বহু ধন-সম্পদ নিয়ে আসেন। হযরত তালহা হযরত সা’দ ইবনে ওবাদা এবং মোহাম্মদ ইবনে মোসলমাও অনেক ধন-সম্পদ নিয়ে হাযির হন। হযরত আসেম ইবনে আদী নব্বই ওয়াসক অর্থাৎ সাড়ে ১৩ হাজার কিলো বা সোয়া তের টন খেজুর নিয়ে আসেন। অন্যান্য সাহাবারাও সাধ্যমত সদকা নিয়ে আসেন। কেউ এক মুঠো কেউ দুই মুঠোও দেন, তাদের এর বেশী দেয়ার সামর্থ ছিলো না।
মহিলারা তাদের হার, বজুবন্দ, ঝুমকা, পা-জেব, বালি, আংটি ইত্যাদি সাধ্যমাফিক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কেদমতে প্রেরণ করেন। কেউ বিরত থাকেননি, কেউ পিছিয়ে থাকেননি। কৃপনতার চিন্তা কারো মনে আসেনি। বেশী বেশী যারা সদকা দিচ্ছিলেন, মোনাফেকরা তাদের খোঁটা দিচ্ছিলো যে, ওরা একটি দু’টি খেজুর দিয়ে কায়সারের দেশ জয় করতে চলেছে। কোরআনের সূরা তাওবায় এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
‘মোমেনদের মধ্যে যারা স্বতস্ফূর্তভাবে সদকা দেয় এবং যারা নিজ শ্রম ব্যতীত কিছুই পায় না, তাদেরকে যারা দোষারোপ ও বিদ্রূপ করে, আল্লাহ তায়ালা তাদরে বিদ্রূপ করেন, ওদের জন্যে আছে মর্মন্তুদ শাস্তি।’
তবুকের পথে মুসলিম সেনাদল:
বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে ইসলামী বাহিনী প্রস্তুত হলো। প্রিয় নবী এরপর মোহাম্মদ ইবনে মোসলামা মতান্তরে ছাবা ইবনে আরফাতাকে মদীনর গভর্নর নিযুক্ত করেন এবং পরিবার পরিজনের তত্ত্বাবধানের জন্যে হযরত আলীকে (রা.) মদীনায় অবস্থানের নির্দেশ দেন। কিন্তু মোনাফেকরা সমালোচনা করে। এর ফলে হযরত আলী (রা.) মদীনা থেকে বেরিয়ে পড়েন এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মিলিত হন।
নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে পুনরায় মদীনায় ফেরত পাঠান তিনি বলেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তোমার সাথে আমার সম্পর্ক মূসা এবং হারুনের সম্পর্কের মতো। অবশ্য, আমার পরে কোন নবী আসবে না।
তাবুকের কাছাকাছি পৌঁছার পর নবী আল-আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ইনশা -আল্লাহ আগামীকাল তোমরা তবুকের জলাশয়ের কাছে পৌঁছে যাবে। তবে চাশত-এর সময়ের আগে পৌঁছুতে পারবে না। যারা আগে পৌঁছুবে তারা যেন আমি না যাওয়া পর্যন্ত ওখানের পানিতে হাত না দেয়।
হযরত মায়া‘য (রা.) বলেন, তবুকে আমরা পৌঁছে দেখি আমাদের দু’জন সঙ্গী আগেই সেখানে পৌঁছলেন। ঝর্ণা থেকে অল্প অল্প পানি উঠছিলো। নবী আল-আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এখানের পানিতে হাত লাগিয়েছো? তারা বললো, হাঁ। নবী একথা শুনে আল্লাহ তায়ালা যা চেয়েছিলেন তাই বললেন। এরপর ঝর্ণা থেকে আজলার সামন্য পানি নিলেন।
ধীরগতিতে আসা পানি হাতের তালুতে জমা হওয়ার পার সে পানি দিয়ে হাতমুখ ধুলেন তারপর সে পানিও ঝর্ণায় ফেলে দিলেন। এরপর ঝর্ণায় প্রচুর পানি উঠতে লাগলো। সাহাবারা তৃপ্তির সাথে সে পানি পান করলেন। এরপর নবী আমাকে বললেন, হে মায়া’য যদি তুমি দীর্ঘজীবী হও, তবে দেখতে পাবে যে, এখানে বাগান সজীব হেয় উঠেছে। [3]
তবুকে ইসলামী বাহিনী:
ইসলামী বাহিনী তবু অবতরণের পর তাঁবু স্থাপন করলেন। তারা রোমক সৈন্যদের সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত ছিলেন। নবী আল-আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তেজস্বিনী ভাষায় সাহাবাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। সে ভাষণে তিনি দুনিয়া ও আখরাতের কল্যাণের জন্যে সাহাবাদের অনুপ্রাণিত করালেন, সুসংবাদ দিলেন। এই ভাষণে সৈন্যদের মনোবল বেড়ে গেলো। কোন কিছুর অভাবই তাদের মুখ্য মনে হলো না।
অন্যদিকে রোম এবং তাদের বাহিনীর অবস্থার এমন হলো যে, তারা বিশাল মুসলিম বাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে ভীত হয়ে পড়লো, সামনে এগিয়ে মোকাবেলা করার সাহস করতে পারল না। তারা নিজেদের শহরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লো। বিধর্মীদের এ পিছুটান মুসলামনদের জন্যে কল্যাণকর প্রমাণিত হলো। আরব এবং আরবের বাইরে মুসলানদের সামরিক শক্তির শ্রেষ্ঠত্বের আলোচনা হতে লাগলো। এ অভিযানে মুসলানরা যে রাজনৈতিক সাফল্য লাভ করে রোমকদের সাথে যুদ্ধ করলে সেই সাফল্য অর্জন সম্ভব হতো না।
বিবরণ এই যে, আায়েলার শাসনকর্তা ইয়াহানা ইবনে রওবা নবী আল-আমিনের কাছে এসে জিজিয়া আদয়ের শর্ত মেনে নিয়ে সন্ধি চুক্তি করলেন। জাররা এবং আজরুহ-এর অধিবাসীরাও হাযির হয়ে জিজিয়া দেয়ার শর্ত মেনে নিলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে একটি চুক্তিপত্র লিখে দিলেন, তারা সেটি কাছে রাখলো। আয়েলোর শাসনকর্তাকে লিখে দেয়া একটি চুক্তি বা সন্ধিপত্র ছিল নিম্মরূপ,
পরম করুনাময় ও অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। এ শান্তি পরওয়ানা আল্লাহ এবং নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে ইয়াহনা ইবনে রওবা এবং আয়েলার অধিবাসীদের জন্যে লেখা হচ্ছে। জলেস্থলে তাদের কিশতি এবং কাফেলার জন্যে আল্লাহর জিম্মা এবং নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জিম্মা এবং এই জিম্মা সেইসব সিরীয় ও সমুদ্রের বাসিন্দাদের জন্যে যারা ইযাহনার সাথে থাকবে।
তবে হাঁ, এদের মধ্যে যদি কেউ গোলমাল পাকায়, তবে তার অর্থ-সম্পদ তার জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে মোহাম্মদ পারবে না। এ ধরনের ব্যক্তির ধন-সম্পদ যে কেউ গ্রহণ করবে, সেটা গৃহীতার জন্যে বৈধ হবে। ওদের কোন কূপে অবতরণ এবং জলেস্থলে কোন পথে চলাচলের ক্ষেত্রে নিষেধ করা যাবে না।’
মদীনায় প্রত্যাবর্তন:
ইসলামী বাহিনী তবুক থেকে সফল ও বিজয়ীর বেশে ফিরে আসে। কোন সংঘর্ষ হয়নি। যুদ্ধের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা ছিলেন মোমেনীদের জন্যে যথেষ্ট। পথে এক জায়গায় একটি ঘাঁটিতে ১২জন মোনাফেক নবী আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করার চেষ্টা করে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ছিলেন হযরত আম্মার (রা.)। তিনি উটের রশি ধরে এগুচ্ছিলেন।
পেছনে হযরত হোযায়ফা ইবনে ইয়ামান (রা.)। তিনি উট হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। অন্য সাহাবারা তখন ছিলেন দূরে। মেনাফেক কুচক্রীরা এ সময়কে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে নাপাক ইচ্ছা চরিতার্থ করতে সামনে অগ্রসর হলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সফরসঙ্গী দুইজন সাহাবী মোনাফেকদের পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলেন। ১২ জন মোনাফেক নিজেদের চেহারা ঢেকে অগ্রসর হচ্ছিল।
প্রিয় নবী ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। তিনি হযরত হোযায়ফাকে পাঠালেন। হযরত হোযায়ফা পেছনের দিকে গিয়ে মোনাফেকদের বাহন উটগুলোকে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে লাগলেন। এই আঘাতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রভাবিত করলেন। তারা দ্রুত পেছনের দিকে গিয়ে সাহাবায়ে কেরামের সাথে মিশে গেলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের নাম প্রকাশ করে চক্রান্ত ফাঁস করে দিলেন।
এ কারণ হযরত হোযায়ফাকে বলা হয় ‘রাযদান ’অর্থাৎ গোপনীয়তা রক্ষাকারী। এ ঘটনা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অ হাম্মু বেমা লাম ইয়া নালু’ অর্থাৎ তারা এ কাজের জন্যে ইচ্ছা করেছিলো কিন্তু তারা তা করতে পারেনি।
সফরের শেষ পর্যায়ে নবী আল আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দূর থেকে মদীনা দেখে বললেন, ওই হচ্ছে তাবা ওই হচ্ছে ওহুদ। এটি সেই পাহাড় যে পাহাড় আমাকে ভালোবাসে এবং যে পাহাড়কে আমিও ভালোবাসি।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তবুকের উদ্দেশ্যে রজব মাসে রওয়ানা হয়েছিলেন এবং রমযান মাসে ফিরে এসেছিলেন। এই সফরে পুরো ৫০ দিন সময় অতিবাহিত হয়েছিলো। তন্মধ্যে ২০দিন তিনি তবুকে ছিলেন আর ৩০দিন লেগেছিলো যাওয়া আসায়। জীবদ্দশায় সশরীরে উপস্থিত থেকে এটাই ছিলো নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেষ জেহাদ।
হযরত আবু বকরের (রা.) নেতৃত্বে হজ্জ পালন:
নবম হিজরীতে যিলকদ বা যিলজ্জ মাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিদ্দিকে আকবর হযরত আবু বকরকে (রা.) আমিরুল হজ্জ করে মক্কায় প্রেরণ করেন।
এরপর সূরা তাওবার প্রথামংশ নাযিল হয়। এতে মোশরেকদের সাথে কৃত অঙ্গীকার সমতার ভিত্তিতে শেষ করার নির্দেশ দেয়া হয়। এ নির্দেশ আসার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলীকে (রা.) এ ঘোষণা প্রকাশের জন্যে প্রেরণ করেন। আরবদের মধ্যে অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে এটাই ছিলো রীতি। হযরত আবু বকরের (রা.) সাথে হযরত আলীর সাক্ষাৎ হয়েছিল দাজনান মতান্তরে আরজ প্রান্তরে। হযরত আবু বকর (রা.) জিজ্ঞাসা করলেন তুমি আমীর না মামুর? হযরত আলী (রা.) বললেন, মামুর।
এরপর উভযে সামনে অগ্রসর হন। এরপর উভয়ে সামনে অগ্রসর হন। হযরত আবু বকর লোকদের হজ্জ করান। ১০ই যিলহজ্জ অর্থাৎ কোরবানীনর দিনে হযরত আলী (রা.) হাজীদের পাশে দাঁড়িয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ অনুযায়ী ঘোষণা দেন। অর্থাৎ সকল প্রকার অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির সমাপ্তির কথা ঘোষণা করেন।
চার মাসের সময় দেয়া হয়। যাদের সাথে কোন অঙ্গীকার ছিলো না, তাদেরকেও চার মাস সময় দেয়া হয় তবে মুসলমানদের সাথে যেসব মোশরেক অঙ্গীকার পালনে ক্রুটি করেনি এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে অন্যদের সাহায্যে করেনি, তাদের চুক্তিপত্র নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত বলবৎ রাখা হয়।
হযরত আবু বকর (রা.) কয়েকজন সাহাবাকে পাঠিয়ে এ ঘোষণা করান যে, ভবিষ্যতে কোন মোশরেক হজ্জ করতে এবং নগ্নাবস্থায় কেউ কাবাঘর তাওয়াফ করতে পারবে না। এ ঘোষণা ছিলো প্রকৃতপক্ষে জাযিরাতুল আরব থেকে মূর্তি পূজার অবসানের চূড়ান্ত পদক্ষেপ। অর্থাৎ এ বছরের পর থেকে মূর্তি পূজার উদ্দেশ্যে আসার জন্যে কোন সুযোগই আর থাকলো না। [4]
ফুটনোট:
[সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৭৩০]
[জামে তিরিমিয, মানাকের ওসমান ইবনে আফফান, ২য় খন্ড, পৃ-২১১]
[মুসরিম শরীফ, ২য় খন্ড, পৃ-২৪৬]
[বিস্তারিত জানার জন্য দ্রষ্টব্য, সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-২২০, ৪৫১, ২য় খন্ড ৬২৬, ৬৭১, যাদুল মায়াদ ৩য় খন্ড, পৃ- ৫৪৩-৫৪৬, তাফসীর গ্রন্থাবলী সূরা বারাআতের প্রথামাংশ]
হোনায়েনের যুদ্ধ
★★★ আকস্মিক অভিযানে মক্কা বিজয় সংঘটিত হয়েছিলো। এতে আরবের জনগণ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলো। প্রতিবেশী গোত্রসমূহের মধ্যে এ অপ্রতাশিত অভিযানের মোকবেলা করার শক্তি ছিলো না। এ কারণে শক্তিশালী অহংকারী উচ্ছৃঙ্খল কিছু গোত্রসমূহ এবং বনু বেলালের কিছু লোক শামিল হয়েছিলো। এসব গোত্রের সম্পর্ক ছিলো কাইসে আইলানের সাথে।
মুসলমানদের কাছে আত্মসমর্পণ করা তারা আত্মমর্যাদার পরিপন্থী মনে করছিলো। তাই তারা মালেক ইবনে আওফ নসরীর কাছে গিয়ে মুসলমানদের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত নিলো।
সিদ্ধান্তের পর মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করতে মালেক ইবনে আওফের নেতৃত্বে সকল সমবেত সকল অমুসলিম রওয়ানা হলো। তারা তাদের পরিবার-পরিজন এবং পশুপাল নিজেদের সঙ্গে নিয়ে চললো। আওতাস প্রান্তরে তারা উপস্থিত হলো। আওতাস হচ্ছে হোনায়েনের কাছে বনু হাওয়ানে এলাকার একটি প্রান্তর। কিন্তু এ প্রান্তর হোনায়েন থেকে পৃথক। হোনয়েন একটি পৃথক প্রান্তর। এটি যুল মাজাজ-এর সন্নিকটে অবস্থিত। সেখান থেকে আরাফাত হয়ে মক্কার দূরত্ব দশ মাইলের বেশী। [1]
মক্কা থেকে হোনায়েনের পথ যাত্রা:
অষ্টম হিজরীর ৬ই শাওয়াল রোববরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে হোনায়েনের উদ্দেশ্যে রওয়ান হলেন। এটা ছিলো তাঁর মক্কায় আগমনের উনিশতম দিন। তাঁর সঙ্গে ছিল ১২ হাজার সৈন্য। এদের মধ্যে ১০ হাজার মদীন থেকে মক্কায় এসেছিলেন, বাকি ২ হাজার মক্কা থেকে রওয়ান হন। মক্কার ২ হাজারের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন নও মুসলিম।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সফওয়ান ইবনে উমাইয়ার কাছ থেকে অস্ত্রসহ একশত বর্ম ধার নিলেন। আত্তাব ইবনে আছিদকে মক্কার গভর্ণর নিযুক্ত করলেন।
দুপুরের পরে একজন সাহাবী এসে বললেন, আমি অমুক পাহাড়ে উঠে দেখেছি বনু হাওয়াযেন সপরিবারে যুদ্ধ করতে এসেছে। তারা নিজেদের পশুপালও সঙ্গে এনেছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেসে বললেন, ইনশা আল্লাহ আগামীকাল এগুলো মুসলমানদের গনীমতের মাল হবে।
রাতের বেলা হযরত আনাস ইবনে মারছাদ প্রহরীর দায়িত্ব পালন করলেন। কিছু লোক সৈন্য সংখ্যার আধিক্য দেখে বললেন, আমরা আজ কিছুতেই পরাজিত হব না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথাটিও পছন্দ করলেন না।
মুসলমানদের আকস্মিক হামলা:
১০ই শাওয়াল মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ইসলামী বাহিনী হোনয়েনে পৌঁছুলো। মালেক ইবনে আওফ আগেই এ জায়গায় পৌঁছে রাতের অন্ধকারে তার সৈন্যদের বিভিন্ন স্থানে গোপনভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছিলো। তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো যে, মুসলমানরা আসা মাত্র তাদের ওপর তীর নিক্ষেপ করবে এবং কিছুক্ষণ পর একজোটে হামলা করবে।
এদিকে খুব প্রত্যুষে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সৈন্যদের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করলেন। খুব ভোরে মুসলিম সৈন্যরা হোনায়েনের প্রান্তরে পদার্পন করলেন। শত্রুসৈন্য সম্পর্কে তারা কিছুই জানতেন না। শত্রুরা যে ওঁৎ পেতে রয়েছে এ সম্পর্কে অনবহিত মুসলমান সৈন্যরা নিশ্চিন্তে অবস্থান নেয়ার সময় হঠাৎ করে তাদের ওপর তীরবৃষ্টি শুরু হলো।
কিছুক্ষণ পরই শত্রুরা একযোগে মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। মুসলমানরা ভ্যাবাচেকা খেয়ে ছত্রভঙ্গ হতে শুরু করলেন। এটা ছিলো সুস্পষ্ট পরাজয়। নও মুসলিম আবু সুফিয়ান বললেন, ওরা সমুদ্রপারে না গিয়ে থামবে না। [2]
সাহবারা ছত্রভঙ্গ হতে শুরু করলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডানদিকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, হে লোক সকল, তোমরা আমার দিকে এসো, আমি আবদুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদ। সেই সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কয়েকজন মোহজেরে এবং তাঁর বংশের সাহাবারা ছাড়া অন্য কেউ ছিলো না।
সেই নাযুক সময়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নযিরবিহীন বীরত্ব ও সাহসিকাতার পরিচয় দিলেন। তিনি শত্রুদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন এবং উচ্চস্বরে বলছিলেন, আনান্নবিউল লা কাযেব আনা ইবনু আবদুল মোত্তালেব অর্থাৎ আমি নবী, আমি মিথ্যাবাদী নই, আমি আবদুল মোত্তালেবের পুত্র।
সেই সময় আবু সুফিয়ান এবং হযরত আব্বাস রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খচ্চর ধরে রেখেছিলেন যাতে করে খচ্চর সামনের দিকে ছুটে যেতে না পারে। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর চাচা হযরত আব্বাসকে বললেন, লোকদের যেন তিনি উচ্চস্বরে ডাকতে শুর করেন। হযরত আব্বাসের ছিলো দরাজ গলা।
হযরত আব্বাস বলেন, আমি উচ্চ কন্ঠে ডাকলাম, কোথায় তোমরা বৃক্ষওয়ালা, বাইয়াতে রেদওয়ানওয়ালা। সাহাবার আমার কন্ঠ শুনে এমনভাবে ছুটে আসতে শুরু করলেন যেমন গাভীর আওয়ায শুনে বাছুর ছুটে আসে। সাহাবারা বললেন, আমরা আসছি। [3]
সাহাবারা ছুটে আসতে শুরু করলে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চারিদিকে একশত সাহাবী সমবেত হলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শত্রুর মোকাবেলা করলেন। যুদ্ধ শুরু হলো।
এরপর আনসারদের ডাকা হলো। ক্রমে বনু হারেস ইবনে খাযরাজের মধ্যে এই ডাক সীমিত হয়ে পড়লো। এদিকে সাহাবারা রণাঙ্গণ থেকে যেভাবে দ্রুত চলে গিয়েছিলেন, তেমনি দ্রুত ফিরে আসতে লাগলেন। দেখতে দেখতে প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রণাঙ্গনের দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার চুলো গরম হয়েছে। এরপর একমুঠো ধুলো তুলো ‘শাহাতুল উজুহ’ বলে শত্রুদের উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করলেন। এর অর্থ হচ্ছে চেহারা বিগড়ে যাক। নিক্ষিপ্ত ধুলোর ফলে প্রত্যেক শত্রুর চোখ ধুলি ধুসরিত হলো। তারা পৃষ্ট প্রদর্শন করে প্রাণ নিয়ে পালাতে শুরু করলো।
শত্রুদের পরাজয়:
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধুলো নিক্ষেপের পরই যুদ্ধের চেহারা পাল্টে গেলো শত্রুরা পরাজিত হলো। ছাকিফা গোত্রের ৭০ জন কাফের নিহত হলো। তাদের নিয়ে আসা অস্ত্র ধন-সম্পদ, রসদ, সামগ্রী, নারী, শিশু, পশুপাল সবকিছু মুসলমানদের হস্তগত হলো। আল্লাহ রব্বুল আলামীন এ সম্পর্কে বলেন,
‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে সাহায্য করেছেন বহু ক্ষেত্রে এবং বিশেষ করে হোনায়নের যুদ্ধের দিনে, যখন তোমাদেরকে উৎফুল্ল করেছিলো তোমাদের সংখ্যাধিক্যে এবং তা তোমাদের কোন কাজে আসেনি এবং বিস্তৃত হওয়া সত্তেও পৃথিবী তোমদের জন্যে সঙ্কুচিত হয়েছিলো এবং পরে তোমরা পৃষ্ট প্রদর্শন করে পলায়ন করেছিলে, অতপর আল্লাহ তায়ালা তাঁর কাছ থেকে তাঁর রসূল এবং মোমেনদের ওপর প্রশান্তি বর্ষণ করেন এবং এমন এক সৈন্য বাহিনী প্রেরণ করেন যা তোমরা দেখতে পাওনি এবং তিনি কাফেরদের শাস্তি প্রদান করেন। এটা কাফেরদের কর্মফল।‘(সূরা তাওবা, আয়াত ২৫-২৬)
পরাজিত শত্রুদের সবচেয়ে বড় দল তায়েফের দিকে অগ্রসর হলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গনীমতের মাল জমা করার পর তায়েফের পথে রওয়ানা হলেন।
গনীমতের মালের বিবরণ নিম্মরূপ। যুদ্ধবন্দী ৬ হাজার, উট ২৪ হাজার। বকরি ৪০ হাজারের বেশী। চাঁদি ৪ হাজার উকিয়া। অর্থাৎ ১ লাখ ৬০ হাজার দিরহাম। এর ওজন ৬ কুইন্টালের চেয়ে কয়েক কিলো কম।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমুদয় মালামাল জমা করার নির্দেশে দিলেন। যেরানা নামক জায়গায় সমুদয় সম্পদ একত্রিত করে হযরত মাসউ ইবনে আমর গেফারী (রা.)-এর নিয়ন্ত্রণে রাখলেন। তায়েফ যুদ্ধ থেকে অবসর না পাওয়া পর্যন্ত এগুলো বন্ট করা হয়নি।
তায়েফের যুদ্ধ:
প্রথমে খালিদ ইবনে ওলীদের নেতৃত্বে এক হাজার সৈন্য পাঠানো হয়, এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রওয়ান হন। পথে নাখলা, ইমানিয়া এবং মনযিল অতিক্রম করেন। লিয়াহ নামক জায়গায় মালেক ইবনে আওফের একটি দুর্গ ছিলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশে সেই দুর্গ ধ্বংস করে দেয়া হয়। এরপর সফর অব্যাহত রেখে তয়েফ পৌঁছার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফ দুর্গ অবরোধ করেন।
অবরোধ দীর্ঘস্থায়ী হয়। সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আনাসের (রা.) বর্ণনা অনুযায়ী এই অবরোধ ৪০ দিন স্থায়ী হয়। কোন কোন সীরাত রচয়িতা ২০ দিন বলেও উল্লেখ করেছেন। কেউ ১০, কেউ ১৫ আবার কেউ ১৮ দিন উল্লেখ করেছেন। [4]
অবরোধকালে উভয় পক্ষের মধ্যে তীর ও পাথর নিক্ষেপ করা হয়। মুসলমানদের প্রথম অবরোধকালে তাদের ওপর লাগাতার তীর নিক্ষেপ করা হয়। প্রথম অবস্থায় মুসলমানরা অবরোধ শুরু করলে দূর্গের ভেতর থেকে তাদের ওপর এতো বেশী তীর নিক্ষেপ করা হয়েছিলো যে মনে হয়েছিলো পঙ্গপাল ছায়া বিস্তার করেছে। এতে কয়েকজন মুসলমান আহত এবং ১২ জন শহীদ হন। ফলে মুসলমানরা তাঁবু সরিয়ে কিছুটা দূরে নিয়ে যান।
এর পরিস্থিতি মোকাবেলায় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ যন্ত্র স্থাপন করেন এবং দূর্গ লক্ষ্যে করে কয়েকটি গোলা নিক্ষেপ করেন। এতে দেয়ালে ফাটল ধরে ছিদ্র হয়ে যায়। সাহাবারা সেই ছিদ্র দিয়ে তাদের প্র্রতি পাথর নিক্ষেপ করেন। কিন্তু শত্রুদের পক্ষ থেকে বৃষ্টির মতো তীর নিক্ষেপ করা হয়, এতে কয়েকজন মুসলমান শহীদ হন।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শত্রুদের কাবু করতে কৌশল হিসাবে আঙ্গুর গাছ কেটে পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। এতে বিচলিত ছকিফ গোত্র আল্লাহ তায়ালা এবং আত্মীয়তার সম্পর্কের দোহাই দিয়ে এ কাজ থেকে বিরত থাকার আবেদন জানালো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা মঞ্জুর করলেন।
অবরোধ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে পড়লো এবং শত্রদের আত্মসমর্পণের কোন লক্ষণ দেখা গেলো না। তারা বছরের খাদ্য দুর্গের ভেতরে মজুদ করে রেখেছিলো। এ সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নওফেল বিনে মাবিয়া দয়লির সাথে পরামর্শ করেন। নওফেল বলেন, শৃগাল তার গর্তে গিয়ে ঢুকেছে। যদি আপনি অবরোধ দীর্ঘায়িত করেন, তবে তাদের পাকড়াও করতে পারবেন।
আর যদি ফিরে যান, তবে তারা আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। একথা শুনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবরোধ অবসানের সিদ্ধান্ত নিলেন। হযরত ওমর (রা.) সাহাবাদের মধ্যে ঘোষণা প্রচার করলেন যে, ইনশা আল্লাহ আগামীকাল আমরা ফিরে যাব । সহাবারা এ ঘোষণার সমালোচনা করলেন। তারা বললেন, এটা কেমন কথা? তায়েফ জয় না করে আমরা ফিলে যাব?
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহবাদের ভিন্নমত শুনে বললেন, আচ্ছা কাল সকালে যুদ্ধে চলো। পরদিন সাহাবারা যুদ্ধে গেলেন, কিন্তু আঘাত খেয়ে ফিরে আসা ছাড়া অন্য কোন লাভ হলো না। এ অবস্থা দেখে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ইনশা আল্লাহ আগামীকাল আমরা ফিরে যাবো। সর্বস্তরের সাহাবারা এ সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। তারা চুপচাপ জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে শুরু করলেন। এ অবস্থা দেখে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃদু হাসতে লাগলেন।
ওমরাহ এবং মদীনায় প্রত্যাবর্তন:
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হোনায়েনের গনীমতের মাল বন্টন শেষে যেরানা থেকে ওমরাহর জন্যে এহরাম বাঁধেন এবং ওমরাহ আদায় করেন। এরপর আত্তাব ইবনে আছিদকে মক্কার গভর্নর করেন।। মোহাম্মদ গাযালী বলেন, এই বিজয়ের সময় যখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর মাথায় ফতহে আযিমের মুকুট পরালেন, এই সময়ে এবং আট বছর আগে এই শহরে আসার সময়ের মধ্যে কতো ব্যবধান।
তিনি এই শহরে এমনভাবে এসেছিলেন যে, তিনি ছিলেন নিরাপত্তার প্রত্যাশী। সেই সময় তিনি ছিলেন অচেনা, অপরিচিত, সংশয় ছিলো তাঁর মনে। সে সময় স্থানীয় অধিবাসীরা তাঁকে মর্যাদা দিয়েছিলো আশ্রয় দিয়েছিলো, সাহায্য করেছিলো, তিনি যে নূর সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তারা সেই নূরের আনুগত্য করেছিলো। শুধু তাই নয় তার জন্যেই তারা অন্যদের সব রকমের শত্রুতা তুচ্ছ মনে করেছিলো। আট বছর আগে এই মদীনায় হিজরত করার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিলো তারাই আজ পুনরায় সম্বর্ধনা দিচ্ছে।
আজ মক্কা তাঁর করতলগত, তাঁর নিয়ন্ত্রণে। মক্কার জনগণ তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মূর্খতা দয়াল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পদতলে বিসর্জন দিয়েছে। তিনি তাদের অতীত দিনের সকল অন্যায় ক্ষমা করে দিয়ে তাদেরকে ইসলামের মাধ্যমে গৌরব ও সাফল্য দান করেছেন। আল্লাহ তায়াল কোরআনে হাকিমে বলেন,
‘নিশ্চয় যে ব্যক্তি সত্যবাদিতা এবং ধৈর্য অবলম্বন করে, তবে আল্লাহ তায়ালা পুন্যশীলদের বিনিময় নষ্ট করেন না। ’[5]
ফুটনোট:
[ফতহুল বারী, ৮ম খন্ড,পৃ.২৭টনোট
[সহীহ বোখারী, ইয়ওমে হোনায়েন অধ্যায়]
[সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ-১০০]
[ফতহুল বারী, ৮ম খন্ড,পৃ-৪৫]
[ ফেকহুস সিরাহ পৃ-৩০৬, মক্কা বিজয় এবং তায়েফের যুদ্ধ বিস্তারিত জানার জন্যে দেখুন যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ-১৬০-২০১,ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ-৩৮৯-৫০১, সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৬১২-৬২৩, ফতহুল বারী, ৮ম খন্ড, পৃ-৩-৮৫]
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মক্কা বিজয়
★★★ (৮ম হিজরী ১৭ই রামাযান মঙ্গলবার; ৬৩০ খৃঃ, ১লা জানুয়ারী)
জন্মভূমি মক্কা হতে হিজরত করার প্রায় আট বছর পর বিজয়ীর বেশে পুনরায় মক্কায় ফিরে এলেন মক্কার শ্রেষ্ঠ সন্তান বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত, নবীকুল শিরোমণি শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)। বিনা যুদ্ধেই মক্কার নেতারা তাঁর নিকটে আত্মসমর্পণ করলেন।
এতদিন যারা ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও মুসলমানদের যাবতীয় দুঃখ-কষ্টের মূল কারণ। বিজয়ী রাসূল (সাঃ) তাদের কারু প্রতি কোনরূপ প্রতিশোধ নিলেন না। সবাইকে উদারতা ও ক্ষমার চাদরে ঢেকে দিয়ে বললেন, ‘আজ তোমাদের উপরে কোনরূপ অভিযোগ নেই, তোমরা মুক্ত’।
অভিযানের কারণ:
প্রায় দু’বছর পূর্বে ৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে সম্পাদিত হোদায়বিয়াহর চার দফা সন্ধিচুক্তির তৃতীয় দফায় বর্ণিত ছিল যে, ‘যে সকল গোত্র মুসলমান বা কুরায়েশ যে পক্ষের সাথে চুক্তিবদ্ধ হবে, তারা তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে এবং তাদের কারু উপরে অত্যাচার করা হলে সংশ্লিষ্ট দলের উপরে অত্যাচার বলে ধরে নেওয়া হবে’। উক্ত শর্তের আওতায় মক্কার নিকটবর্তী গোত্র বনু খোযা‘আহ মুসলমানদের সাথে এবং বনু বকর কুরায়েশদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে সংশ্লিষ্ট দলের মিত্রপক্ষ হিসাবে গণ্য হয়।
কিন্তু দু’বছর পুরা না হতেই বনু বকর উক্ত চুক্তি ভঙ্গ করল এবং ৮ম হিজরীর শা‘বান মাসে রাত্রির অন্ধকারে বনু খোযা‘আহর উপরে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে বহু লোককে হতাহত করল। ঐসময় বনু খোযা‘আহ গোত্র ‘ওয়াতীর’ নামক প্রস্রবনের ধারে বসবাস করত, যা ছিল মক্কার নিম্নভূমিতে অবস্থিত (মু‘জামুল বুলদান)। বনু বকরের এই অন্যায় আক্রমনে কুরায়েশদের ইন্ধন ছিল।
তারা অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করেছিল। এমনকি কুরায়েশ নেতা ইকরিমা বিন আবু জাহল, ছাফওয়ান বিন উমাইয়া এবং খোদ হোদায়বিয়া সন্ধিচুক্তিতে কুরায়েশ পক্ষের আলোচক ও স্বাক্ষর দানকারী সোহায়েল বিন আমর সশরীরে উক্ত হামলায় অংশগ্রহণ করেন (তারীখে ত্বাবারী)। [1]
বনু খোযা‘আহ গোত্রের এই হৃদয়বিদারক দুঃসংবাদ নিয়ে আমের ইবনু সালেম আল-খোযাঈ ৪০ জনের একটি দল সহ দ্রুত মদীনায় আসেন। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তখন মসজিদে নববীতে ছাহাবায়ে কেরাম সহ অবস্থান করছিলেন।
বনু খোযা‘আহর আবেদনে রাসূলের সাড়া:
আমর ইবনু সালেম-এর মর্মস্পর্শী কবিতা শোনার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলে ওঠেন ‘তুমি সাহায্যপ্রাপ্ত হয়েছ হে আমর ইবনু সালেম’! এমন সময় আসমানে একটি মেঘখন্ডের আবির্ভাব হয়। তা দেখে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘এই মেঘমালা বনু কা‘বের সাহায্যের শুভসংবাদে চমকাচ্ছে’।
এরপর বনু খোযা‘আহর আরেকটি প্রতিনিধিদল নিয়ে বুদাইল বিন অরক্বা আল-খোযাঈ আগমন করেন এবং তাদের গোত্রের কারা কারা নিহত হয়েছে ও কুরায়েশরা কিভাবে বনু বকরকে সাহায্য করেছে, তার পূর্ণ বিবরণ পেশ করেন। অতঃপর তারা মক্কায় ফিরে যান। [4]
রাসূলের পরামর্শ বৈঠক:
সন্ধিচুক্তি ভঙ্গের পর করণীয় সম্পর্কে আলোচনার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে বৈঠকে বসেন। এক সময় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলে ওঠেন, ‘আমি যেন তোমাদেরকে আবু সুফিয়ানের সাথে দেখছি যে, সে মদীনায় আসছে তোমাদের কাছে চুক্তি পাকাপোক্ত করার জন্য এবং মেয়াদ বাড়ানোর জন্য’। [5]
আবু সুফিয়ানের মদীনা আগমন ও আশ্রয় প্রার্থনা:
দূরদর্শী আবু সুফিয়ান বুঝেছিলেন যে, বনু খোযা‘আহর উপরে এই কাপুরুষোচিত আক্রমণ হোদায়বিয়াহর সন্ধিচুক্তির স্পষ্ট লংঘন এবং এর প্রতিক্রিয়া হল মুসলমানদের প্রতিশোধমূলক আক্রমণ, যা ঠেকানোর ক্ষমতা এখন তাদের নেই। তাই তিনি মোটেই দেরী না করে এবং কোন প্রতিনিধি না পাঠিয়ে কোরায়েশ নেতাদের পরামর্শক্রমে সরাসরি নিজেই মদীনা গমন করলেন।
পথিমধ্যে খোযা‘আহ নেতা বুদাইল বিন অরক্বার সঙ্গে আসফান নামক স্থানে সাক্ষাত হলে তিনি মুহাম্মাদের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা অস্বীকার করেন। কিন্তু সুচতুর আবু সুফিয়ান বুদাইলের উটের গোবরের মধ্যে খেজুরের আঁটি পরীক্ষা করে বুঝে নেন যে, বুদাইল মদীনা গিয়েছিল। এতে তিনি আরো ভীত হয়ে পড়েন।
যাইহোক মদীনা পৌঁছে তিনি স্বীয় কন্যা উম্মুল মুমেনীন উম্মে হাবীবাহর সাথে সাক্ষাত করেন। এসময় তিনি খাটে বসতে উদ্যত হলে কন্যা দ্রুত বিছানা গুটিয়ে নেন ও বলেন, ‘এটি রাসূল (সাঃ)-এর বিছানা। এখানে আপনার বসার অধিকার নেই। কেননা আপনি অপবিত্র মুশরিক’। অতঃপর আবু সুফিয়ান বেরিয়ে জামাতা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে গেলেন ও সব কথা বললেন।
কিন্তু রাসূল (সাঃ) কোন কথা বললেন না। নিরাশ হয়ে তিনি আবুবকর (রাঃ)-এর কাছে গেলেন এবং তাকে রাসূলের নিকটে কথা বলার অনুরোধ করলেন। কিন্তু তিনি অপারগতা প্রকাশ করলেন। অতঃপর ওমরের কাছে গিয়ে একইভাবে তোষামোদ করলেন।
কিন্তু ওমর কঠোর ভাষায় জবাব দিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের নিকটে সুফারিশ করব? আল্লাহর কসম! যদি আমি কিছুই না পাই ছোট নুড়ি ছাড়া, তাই দিয়ে আমি তোমাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করব’।
এবার সবশেষে তিনি আলী (রাঃ)-এর কাছে গেলেন। এ সময় সেখানে ফাতেমা (রাঃ) ছিলেন এবং তাদের সামনে শিশু হাসান লাফালাফি করে খেলছিলেন। আবু সুফিয়ান সেখানে পেঁŠছে আলী (রাঃ)-কে অত্যন্ত বিনয়ের সুরে বললেন, হে আলী! অন্যদের তুলনায় তোমার সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক অনেক গভীর। আমি একটি বিশেষ প্রয়োজনে মদীনায় এসেছি।
এমনটি যেন না হয় যে, আমাকে নিরাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়। ‘তুমি আমার জন্য মুহাম্মাদের নিকটে সুফারিশ কর’। জবাবে আলী (রাঃ) বললেন,‘তোমাদের জন্য দুঃখ হে আবু সুফিয়ান! আল্লাহর রাসূল (সাঃ) একটি বিষয়ে কৃত সংকল্প হয়েছেন, যে বিষয়ে আমরা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারি না’।
রাসূলের গোপন প্রস্তুতি:
ত্বাবারাণী হাদীছ গ্রন্থের বর্ণনাসূত্রে জানা যায় যে, কুরায়েশদের চুক্তি ভঙ্গের খবর পৌঁছবার তিন দিন আগেই আল্লাহর রাসূল (সাঃ) স্ত্রী আয়েশাকে সফরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের আদেশ দেন- যা কেউ জানত না। পিতা আবুবকর (রাঃ) কন্যা আয়েশাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে কন্যা! এসব কিসের প্রস্তুতি? কন্যা জবাব দিলেন و‘আল্লাহর কসম! আমি জানি না’।
আবুবকর (রাঃ) বললেন, এখন তো রোমকদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় নয়। তাহলে রাসূল (সাঃ) কোন দিকের এরাদা করেছেন? আয়েশা (রাঃ) আবার বললেন, ‘আল্লাহর কসম! এ বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই’। দেখা গেল যে, তৃতীয় দিন আমর ইবনু সালেম আল-খোযাঈ ৪০ জন সঙ্গী নিয়ে হাযির হলেন। তখন লোকেরা চুক্তিভঙ্গের খবর জানতে পারল। [6]
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সবাইকে মক্কা গমনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন এবং আল্লাহর নিকটে দো‘আ করলেন- ‘হে আল্লাহ! তুমি কুরায়েশদের নিকটে গোয়েন্দা রিপোর্ট এবং এই অভিযানের খবর পৌঁছানোর পথ সমূহ বন্ধ করে দাও। যাতে তাদের অজান্তেই আমরা তাদের শহরে হঠাৎ উপস্থিত হতে পারি’। [7]
অতঃপর বাহ্যিক কৌশল হিসাবে তিনি আবু ক্বাতাদাহ হারেছ বিন রিব্‘ঈ -এর নেতৃত্বে ৮ সদস্যের একটি দলকে ১লা রামাযান তারিখে ‘ইযাম’ উপত্যকার দিকে রওয়ানা করে দেন। যাতে শত্রুরা ভাবে যে, অভিযান ঐদিকেই পরিচালিত হবে। পরে তারা গিয়ে রাসূল (সাঃ-এর সাথে মিলিত হন। [8]
অভিযান পরিকল্পনা ফাঁসের ব্যর্থ চেষ্টা ও চিঠি উদ্ধার:
বদর যুদ্ধের নিবেদিতপ্রাণ ছাহাবী এবং রাসূলের দান্দান মুবারক শহীদকারী উৎবা বিন আবী ওয়াকক্বাছের হত্যাকারী প্রসিদ্ধ বীর হযরত আবু বালতা‘আহ (রাঃ) রাসূলের আসন্ন মক্কা অভিযানের খবর দিয়ে একটি পত্র লিখে এক মহিলার মাধ্যমে গোপনে মক্কায় প্রেরণ করেন।
অহি-র মাধ্যমে খবর অবগত হয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আলী ও মিক্বদাদ (রাঃ)-কে দ্রুত পশ্চাদ্ধাবনের নির্দেশ দিয়ে বলেন, তোমরা ‘খাখ’ নামক বাগিচায় গিয়ে একজন হাওদা নশীন মহিলাকে পাবে, যার কাছে কুরায়েশদের নিকটে লিখিত একটি পত্র রয়েছে’। তারা অতি দ্রুত পিছু নিয়ে ঠিক সেখানে গিয়েই মহিলাকে পেলেন ও তাকে পত্রের কথা জিজ্ঞেস করলেন।
মহিলা অস্বীকার করলে তার হাওদা তল্লাশি চালানো হল। কিন্তু না পেয়ে হযরত আলী তাকে বললেন, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মিথ্যা বলেননি, আল্লাহর কসম! অবশ্যই তুমি চিঠিটি বের করে দেবে, নইলে অবশ্যই আমরা তোমাকে উলঙ্গ করব’। তখন মহিলা ভয়ে তার মাথার খোঁপা থেকে চিঠিটা বের করে দিল। পত্রখানা নিয়ে তারা মদীনায় ফিরে এলেন।
তখন হাতেবকে ডেকে রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করবেন না। আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপরে বিশ্বাসী। আমি ধর্মত্যাগী হইনি বা আমার মধ্যে কোনরূপ পরিবর্তনও আসেনি’। তবে ব্যাপারটি হল এই যে, আমি কুরায়েশদের সাথে সম্পৃক্ত একজন ব্যক্তি মাত্র। তাদের গোত্রভুক্ত নই।
অথচ তাদের মধ্যে রয়েছে আমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও সন্তান-সন্ততি। তাদের সাথে আমার কোন আত্মীয়তা নেই, যারা তাদের হেফাযত করবে। অথচ আপনার সাথে যেসকল মুহাজির আছেন, তাদের সেখানে আত্মীয়-স্বজন আছে, যারা তাদের পরিবারকে নিরাপত্তা দিতে পারে। এজন্য আমি চেয়েছিলাম যে, তাদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতি দেখাই, যাতে তারা আমার পরিবারকে নিরাপত্তা দেয়’। তখন ওমর (রাঃ) বলে উঠলেন, হে রাসূল! আমাকে ছেড়ে দিন আমি ওর গর্দান উড়িয়ে দিই।
কেননা সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে খেয়ানত করেছে এবং সে অবশ্যই মুনাফেকী করেছে’। জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘সে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল’। তোমার কি জানা নেই হে ওমর! আহলে বদর সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা যা খুশী করো, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি’। একথা শুনে ওমরের দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল এবং তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল অধিক জ্ঞাত’। [9]
মক্কার পথে রওয়ানা:
৮ম হিজরীর ১০ই রামাযান মঙ্গলবার ১০,০০০ সাথী নিয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হন। এই সময় মদীনার দায়িত্বশীল নিযুক্ত করে যান আবু রুহম কুলছূম আল-গেফারী (রাঃ) -কে। [10]
মুসলিম বাহিনী মক্কার উপকণ্ঠে:
১৭ই রামাযান মঙ্গলবার সকালে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মার্রুয যাহরান ত্যাগ করে মক্কায় প্রবেশের জন্য যাত্রা শুরু করলেন। তিনি আববাসকে বললেন যে, আপনি আবু সুফিয়ানকে (আবু সুফিয়ান মুসলিম বাহিনীর অবস্থান পরিদর্শন কালে বন্দী হাওয়ার আগমুহূর্তে আব্বাস (রাঃ) নিরাপত্তা দেন এবং পরে আবু সুফিয়ান আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এর কাছে ইসলাম গ্রহন করে) নিয়ে উপত্যকা থেকে বের হওয়ার মুখে সংকীর্ণ পথের পার্শ্বে পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে থাকবেন। যাতে সে মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা ও শক্তি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে পারে।
আববাস (রাঃ) তাই-ই করলেন। এরপর যখনই স্ব স্ব গোত্রের পতাকা সহ এক একটি গোত্র ঐ পথ অতিক্রম করে, তখনই আবু সুফিয়ান আববাসের নিকটে ঐ গোত্রের পরিচয় জিজ্ঞেস করেন। যেমন আসলাম, গেফার, জোহায়না, মুযায়না, বনু সোলায়েম ও অন্যান্য গোত্র সমূহ। কিন্তু আবু সুফিয়ান ঐসব লোকদের তেমন মূল্যায়ন না করে বলেন, এদের সাথে আমার কি সম্পর্ক?
এরপরে যখন আনছার ও মুহাজির পরিবেষ্টিত হয়ে লোহার বর্ম পরিহিত অবস্থায় জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে একটি বিরাট দলকে আসতে দেখলেন তখন আবু সুফিয়ান বলে উঠলেন, সুবহানাল্লাহ হে আববাস এরা কারা? আববাস (রাঃ) বললেন, মুহাজির ও আনছার বেষ্টিত হয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আসছেন’।
আবু সুফিয়ান বললেন, ‘কারু পক্ষে এদের সাথে মুক্বাবিলার শক্তি হবে না’। অতঃপর বললেন, হে আবুল ফযল! ‘তোমার ভাতিজার সাম্রাজ্য তো আজকে অনেক বড় হয়ে গেছে’। আববাস (রাঃ) বললেন, ‘হে আবু সুফিয়ান, এটা (রাজত্ব নয় বরং) নবুঅত’। আবু সুফিয়ান বললেন, ‘হাঁ, তাহলে তাই’। [15]
সা‘দের পতাকা হস্তান্তর : এ সময় একটি ঘটনা ঘটে যায়। আনছারদের পতাকা ছিল খাযরাজ নেতা সা‘দ বিন ওবাদাহ (রাঃ)-এর হাতে। তিনি ইতিপূর্বে ঐ স্থান অতিক্রম করার সময় আবু সুফিয়ানকে শুনিয়ে বলেন, ‘আজ হল মারপিটের দিন। আজ হারামকে হালাল করা হবে। আজ আল্লাহ কুরায়েশকে অপদস্থ করবেন’। অতঃপর রাসূল (সাঃ) ঐ স্থান অতিক্রম করার সময় আবু সুফিয়ান বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি শুনেছেন সা‘দ কি বলেছে? জিজ্ঞেস করলেন কি বলেছে?
তখন তাকে সব বলা হল। সেকথা শুনে হযরত ওছমান ও আব্দুর রহমান ইবনু ‘আওফ রাসূল (সাঃ)-কে বললেন, আমরা সা‘দের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত নই। হয়ত সে কুরায়েশদের মারপিট শুরু করে দেবে’। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘বরং আজকের দিনটি হবে কা‘বা গৃহের প্রতি যথার্থ মর্যাদা প্রদর্শনের দিন। আজকের দিনটি হবে সেই দিন, যেদিন আল্লাহ কুরায়েশ বংশের যথার্থ মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করবেন’। [16]
অতঃপর তিনি একজনকে পাঠিয়ে সা‘দের নিকট থেকে পতাকা নিয়ে তার পুত্র ক্বায়েমকে দিলেন। যাতে সে বুঝতে পারে যে, পতাকা তার হাত থেকে বাইরে যায়নি। তবে কেউ কেউ বলেন, পতাকাটি যুবায়ের (রাঃ)-কে প্রদান করা হয়।
মুসলিম বাহিনী কুরায়েশদের মাথার উপরে:
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অতিক্রম করে যাওয়ার পর হযরত আববাস (রাঃ) আবু সুফিয়ানকে বললেন, ‘তোমার কওমের দিকে দৌঁড়াও’। আবু সুফিয়ান অতি দ্রুত মক্কায় গিয়ে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করলেন,‘হে কুরায়েশগণ! মুহাম্মাদ এসে গেছেন, যার মুকাবিলা করার ক্ষমতা তোমাদের নেই। অতএব যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের গৃহে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ থাকবে’।
এ ঘোষণা শুনে তার স্ত্রী হিন্দা এসে তার মোচ ধরে বলে ওঠেন, এই চর্বিওয়ালা শক্ত মাংসধারী মশকটাকে তোমরা মেরে ফেল। এরূপ দুঃসংবাদ দানকারীর মন্দ হৌক’! আবু সুফিয়ান বললেন, তোমরা সাবধান হও! এই মহিলা যেন তোমাদের ধোঁকায় না ফেলে। লোকেরা বলল, হে আবু সুফিয়ান! তোমার ঘরে কয়জনের স্থান হবে? তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি তার নিজের ঘরের দরজা বন্ধ রাখবে, সে নিরাপদ থাকবে এবং যে ব্যক্তি মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে, সেও নিরাপদ থাকবে’। একথা শোনার পর লোকেরা স্ব স্ব ঘর ও বায়তুল্লাহর দিকে দৌঁড়াতে শুরু করল। [17]
কিন্তু কিছু সংখ্যক নির্বোধ লোক ইকরিমা বিন আবু জাহল, ছাফওয়ান বিন উমাইয়া, সোহায়েল বিন আমর প্রমুখের নেতৃত্বে মক্কার ‘খান্দামা’পাহাড়ের কাছে গিয়ে জমা হল মুসলিম বাহিনীকে বাধা দেওয়ার জন্য। [18]
খান্দামায় মুকাবিলা ও হতাহতের ঘটনা:
মুসলিম বাহিনী খান্দামায় পৌঁছানোর পর ডান বাহুর সেনাপতি খালেদ ইবনে ওয়ালীদের সাথে তাদের মুকাবিলা হয়। তাতে ১২ জন নিহত হওয়ার পর তাদের মধ্যে পালানোর হিড়িক পড়ে যায়। কিন্তু এই সময় খালেদ বাহিনীর দু’জন শহীদ হন, যারা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তারা হলেন কুরয বিন জাবের আল-ফিহরী এবং খুনায়েস বিন খালেদ বিন রাবী‘আহ। [19]
অতঃপর খালেদ মক্কার গলিপথ সমূহ অতিক্রম করে ছাফা পাহাড়ে উপনীত হলেন। অন্যদিকে বামবাহুর সেনাপতি যোবায়ের ইবনুল আওয়াম (রাঃ) মক্কার উপরিভাগ দিয়ে প্রবেশ করে হাজূন নামক স্থানে অবতরণ করলেন। একইভাবে আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ পদাতিক বাহিনী নিয়ে বাত্বনে ওয়াদীর পথ ধরে মক্কায় পৌঁছে যান।
বিজয়ীর বেশে রাসূলের মক্কায় প্রবেশ:
অতঃপর আনছার ও মুহাজির পরিবেষ্টিত হয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করলেন ও হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করেন। অতঃপর বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করেন। এই সময় কা‘বা গৃহের ভিতরে ও বাইরে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হাতের ধনুক দ্বারা এগুলি ভাঙতে শুরু করেন এবং কুরআনের এ আয়াত পড়তে থাকেন-
وَقُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوْقًا
‘তুমি বল, হক এসে গিয়েছে, বাতিল অপসৃত হয়েছে’। নিশ্চয়ই বাতিল অপসৃত হয়েই থাকে’ (বনু ইসরাঈল ১৭/৮১)।
তিনি আরও পড়েন,
قُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَمَا يُبْدِئُ الْبَاطِلُ وَمَا يُعِيْدُ
‘তুমি বল হক এসে গেছে এবং বাতিল না শুরু হবে, না আর ফিরে আসবে’ (সাবা ৩৪/৪৯)।
অর্থাৎ সত্যের মুকাবিলায় মিথ্যা এমনভাবে পর্যুদস্ত হয় যে, তা কোন বিষয়ের সূচনা বা পুনরাবৃত্তির যোগ্য থাকে না। অতঃপর ওছমান বিন ত্বালহাকে ডেকে তার কাছ থেকে কা‘বা ঘরের চাবি নিয়ে দরজা খুলে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ভিতরে প্রবেশ করেন। তিনি সেখানে বহু মূর্তি ও ছবি দেখতে পান। অতঃপর তিনি সমস্ত ছবি-মূর্তি নিশ্চিহ্ন করে ফেলার নির্দেশ দেন এবং সাথে সাথে তা পালিত হয়। [20]
অতঃপর তিনি ঘরের মধ্যে ঘুরে ঘুরে দেখেন ও সর্বত্র আল্লাহু আকবর ও লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়তে থাকেন। অতঃপর তিনি দরজা খুলে দেন। এ সময় হাযার হাযার লোক কা‘বা গৃহের সম্মুখে দন্ডায়মান ছিল।
রাসূলের ১ম দিনের ভাষণ : অতঃপর তিনি দরজার দুই পাশ ধরে নীচে দন্ডায়মান কুরায়েশদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। যেখানে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তাঁর কোন শরীক নেই, তিনি তাঁর ওয়াদা সত্যে পরিণত করেছেন। তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং সেনাদলকে একাই পরাভূত করেছেন’। শুনে রাখ, সম্মান ও সম্পদের সকল অহংকার এবং রক্তারক্তি আমার পদতলে নিষ্পেষিত হল।
কেবলমাত্র বায়তুল্লাহর চাবি সংরক্ষণ ও হাজীদের পানি পান করানোর সম্মানটুকু ছাড়া (অর্থাৎ এ দু’টি দায়িত্ব তোমাদের জন্য বহাল রইল)। ভুলবশত হত্যা যা লাঠিসোটা দ্বারা হয়ে থাকে, তা ইচ্ছাকৃত হত্যার সমতুল্য , তাকে পূর্ণ রক্তমূল্য দিতে হবে একশ’টি উট। যার মধ্যে ৪০টি হবে গর্ভবতী। [24]
‘হে জনগণ! আল্লাহ তোমাদের থেকে জাহেলিয়াতের অংশ ও পূর্ব পুরুষের অহংকার দূরীভূত করে দিয়েছেন। মানুষ দু’প্রকারের : মুমিন আল্লাহভীরু অথবা পাপাচারী হতভাগ্য। তোমরা আদম সন্তান। আর আদম ছিলেন মাটির তৈরী’। অতঃপর তিনি নিম্নোক্ত আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوْا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللهَ عَلِيْمٌ خَبِيْرٌ-
‘হে মানবজাতি! আমরা তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী হতে সৃজন করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পার। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকটে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যিনি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে আল্লাহভীরু। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সর্বকিছু খবর রাখেন’ (হুজুরাত ৪৯/১৩)। [25]
অতঃপর বললেন, ‘হে কুরায়েশগণ! আমি তোমাদের সাথে কিরূপ আচরণ করব বলে তোমরা আশা কর’? সবাই বলে উঠল, ‘উত্তম আচরণ। আপনি দয়ালু ভাই ও দয়ালু ভাইয়ের পুত্র’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘শোন! আমি তোমাদের সেকথাই বলছি, যেকথা ইউসুফ তার ভাইদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের প্রতি আজ আর কোন অভিযোগ নেই’ (ইউসুফ ১২/৯২)। যাও তোমরা সবাই মুক্ত’। [26]
কেননা ঐ দিন কাউকে বন্দী করা হয়নি বা গণীমত সংগ্রহ করা হয়নি। বরং সবাই মুক্ত ছিল এবং উপস্থিত সবাই বায়‘আত নিয়ে ইসলাম কবুল করেছিল।
ফুটনোট:
[1] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/২০৯।
[2] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৩৯৪-৯৫।
[3] যাদুল মা‘আদ ৩/৩৪৯।
[4] বায়হাক্বী, যাদুল মা‘আদ৩/৩৪৯।
[5] বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত হা/১৭৫৭, ‘সনদ মুরসাল।
[6] ত্বাবারাণী কাবীর হা/১০৫২; ঐ, ছগীর হা/৯৬৮; সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৩৯৭; যাদুল মা‘আদ ৩/৩৫১।
[7] ফিক্বহুস সীরাহ ১/৩৭৫, সনদ যঈফ।
[8] ওয়াক্বেদী, কিতাবুল মাগাযী, ‘মক্কা বিজয়ের যুদ্ধ’ অনুচ্ছেদ, ২/৩২৩; আর-রাহীক্ব ৩৯৭ পৃঃ।
[9] বুখারী হা/৩৬৮৪ ‘মাগাযী’ অধ্যায়, ‘বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ফযীলত’ অনুচ্ছেদ।
[10] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৩৯৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৩৪১।
[11] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৪০০; আর-রাহীক্ব ৩৯৯ পৃঃ।
[12] হাকেম, ফিক্বহুস সীরাহ ১/৩৭৬, সনদ হাসান।
[13] যাদুল মা‘আদ ৩/৩৫২-৩৫৩।
[14] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৪০৩; মুসলিম, মিশকাত হা/৬২১০; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৩৪১।
[15] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৪০৪; ছহীহাহ হা/৩৩৪১।
[16] বুখারী হা/৪২৮০।
[17] ছহীহাহ হা/৩৩৪১।
[18] যাদুল মা‘আদ ৩/৩৫৬-৫৭।
[19] যাদুল মা‘আদ ৩/৩৫৭।
[20] বুখারী হা/৪২৮৮।
[21] রহমাতুল্লিল আলামীন ১/১১৯।
[22] ফাৎহুল বারী ৩/৫৪৪, ‘হজ্জ’ অধ্যায়-২৫, অনুচ্ছেদ-৫১।
[23] দ্রঃ ফাৎহুল বারী হা/১৫৯৮ ও ১৬০১ নং হাদীছ দ্বয়ের ব্যাখ্যা, ‘হজ্জ’ অধ্যায়, ৫১ ও ৫৪ অনুচ্ছেদ।
[24] আবুদাঊদ হা/৪৫৪৭ সনদ হাসান।
[25] তিরমিযী হা/৩২৭০ সনদ ছহীহ; আবু দাউদ হা/৫১১৬; ঐ, মিশকাত হা/৪৮৯৯।
[26] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৪১২; ফিক্বহুস সীরাহ ১/৩৮২; যঈফাহ হা/১১৬৩, সনদ যঈফ।
ক্বাযা ওমরাহ ও মায়মূনার সাথে রাসূলের বিবাহ
(৭ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ)
হুদায়বিয়া সন্ধির শর্তানুযায়ী রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ওমরাহ করার জন্য প্রস্তুতি নেন। গত বছরে যারা হোদায়বিয়ায় হাযির ছিলেন, তাদের মধ্যে যারা জীবিত আছেন তারা ছাড়াও অন্যান্যগণ মিলে মোট দুহাযার ব্যক্তি রাসূলের সঙ্গে বের হন। মহিলা ও শিশুরা ছিল এই সংখ্যার বাইরে।[1] মুশরিকদের চুক্তি ভঙ্গের আশংকায় যুদ্ধে পারদর্শী লোকদের এবং যুদ্ধাস্ত্র সমূহ সঙ্গে নেয়া হয় (ঐ)।
আবু রুহম ‘ওয়াইফ আল-গেফারী কে মদীনার প্রশাসক নিযুক্ত করে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। সঙ্গে নিলেন কুরবানীর জন্য ৬০টি উট। অতঃপর যুল-হুলায়ফা পৌঁছে ওমরাহর জন্য এহরাম বাঁধলেন এবং সকলে উঁচু স্বরে ‘লাববায়েক’ ধ্বনি দেন। মক্কার নিকটবর্তী ইয়াজেজ নামক স্থানে পেঁŠছে বর্ম, ঢাল, বর্শা, তীর প্রভৃতি যুদ্ধাস্ত্র সমূহ রেখে দেওয়া হল।
আওস বিন খাওলী আনছারীর নেতৃত্বে দু’শো লোককে এগুলির তত্ত্বাবধানের জন্য সেখানে রাখা হল। বাকীরা মুসাফিরের অস্ত্র ও কোষবদ্ধ তরবারিসহ মক্কায় গমন করেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বীয় উষ্ট্রী ক্বাছওয়া -এর পিঠে সওয়ার ছিলেন এবং মুসলমানগণ স্ব স্ব তরবারি কাঁধে ঝুলিয়ে রাসূলকে মাঝে রেখে ‘লাববায়েক’ ধ্বনি দিতে থাকেন। ‘হাজুন’ মুখী টিলার পথ ধরে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মক্কায় প্রবেশ করেন।
মুশরিকরা সব বেরিয়ে মক্কার উত্তর পার্শ্বে ‘কু‘আই ক্বা‘আন’ পাহাড়ের উপরে জমা হয়ে মুসলমানদের আগমন দেখতে থাকে এবং বলাবলি করতে থাকে যে, ইয়াছরিবের জ্বর এদের দুর্বল করে দিয়েছে’। একথা জানতে পেরে রাসূল (সাঃ) সবাইকে নির্দেশ দিলেন যেন ত্বাওয়াফের সময় প্রথম তিনটি চক্কর দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করে, যাকে ‘রমল’ বলা হয়। [2]
তবে রুকনে ইয়ামানী ও হাজারে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থান স্বাভাবিক ভাবে অতিক্রম করবে। এ নির্দেশ তিনি এজন্যে দেন, যাতে মুশরিকেরা মুসলমানদের শক্তি-ক্ষমতা দেখতে পায়। একই উদ্দেশ্যে তিনি তাদের ইযত্বেবার নির্দেশ দেন। যার অর্থ হল ডান কাঁধ খোলা রেখে বগলের নীচ দিয়ে চাদর বাম কাঁধের উপরে রাখা। এর মাধ্যমে একজনকে সদা প্রস্তত ও স্মার্ট দেখা যায়। মুশরিকরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রাসূলকে দেখতে থাকে। এরি মধ্যে তিনি ‘লাববায়েক’ ধ্বনি দিতে দিতে মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন এবং স্বীয় লাঠি দ্বারা হাজারে আসওয়াদ চুম্বন করেন।
অতঃপর ত্বাওয়াফ করেন ও মুসলমানেরাও ত্বাওয়াফ করে। ত্বাওয়াফের সময় আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রাঃ) যুদ্ধছন্দে পাঁচ লাইনের কবিতা বলতে বলতে রাসূলের আগে আগে চলতে থাকেন। এতে হযরত ওমর (রাঃ) তাকে বলেন, ‘হে ইবনে রাওয়াহা! আল্লাহর রাসূলের সামনে ও আল্লাহর হারামের মধ্যে তুমি কবিতা পাঠ করছ’? তখন রাসূল (সাঃ) ওমরকে বললেন, ‘ওকে ছাড় ওমর! এটা ওদের জন্য বর্শার আঘাতের চাইতেও দ্রুত কার্যকরী’।[3]
মুসলমানদের এই দ্রুতগতির ত্বাওয়াফ ও কার্যক্রম দেখে মুশরিকদের ধারণা পাল্টে গেল এবং বলতে লাগল যে, তোমাদের ধারণা ছিল ভুল। ‘বরং ওরা তো দেখছি অমুক অমুকের চাইতে বেশী শক্তিশালী’। [4]
ত্বাওয়াফ শেষে তাঁরা সাঈ করেন এবং এ সময় মারওয়ার নিকটে তাদের কুরবানীর পশুগুলি দাঁড়ানো ছিল। সাঈ শেষে রাসূল (সাঃ) সেখানে গিয়ে বললেন, ‘এটাই হল কুরবানীর স্থান এবং মক্কার সকল অলি-গলি হল কুরবানীর স্থল’। [5]
অতঃপর তিনি সেখানে উটগুলি নহর করেন এবং মাথা মুন্ডন করেন। মুসলমানেরাও তাই করেন। এভাবে হালাল হওয়ার পর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) একদল ছাহাবীকে ইয়াজেজ পাঠিয়ে দেন, যাতে তারা সেখানে গিয়ে অস্ত্র-শস্ত্র পাহারায় থাকে এবং অন্যদের ওমরাহর জন্য পাঠিয়ে দেয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কায় তিনদিন অবস্থান করেন।
চতুর্থ দিন সকালে মুশরিক নেতারা এসে আলী (রাঃ)-কে বলেন যে, সন্ধি চুক্তি অনুযায়ী তিনদিনের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে। এবার তোমাদের নেতাকে যেতে বল। তখন রাসূল (সাঃ) মক্কা থেকে বেরিয়ে এসে ‘সারফ’ নামক স্থানে অবস্থান করেন।
মক্কা থেকে বেরিয়ে আসার সময় সাইয়েদুশ শুহাদা হযরত হামযা (রাঃ)-এর শিশুকন্যা আমাতুল্লাহ হে চাচা হে চাচা বলতে বলতে ছুটে আসে। হযরত আলী (রাঃ) তাকে কোলে তুলে নেন। এরপর আলী, জা‘ফর ও যায়েদ বিন হারেছাহর মধ্যে বিতর্ক হয়। কেননা সবাই তাকে নিতে চান। তখন রাসূল (সাঃ) জা‘ফরের অনুকূলে ফায়ছালা দিলেন। কেননা জা‘ফরের স্ত্রী আসমা বিনতে উমায়েস ছিলেন মেয়েটির আপন খালা। [6]
মায়মূনার সাথে রাসূলের বিবাহ:
অত্র ওমরাহ পালন শেষে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মায়মূনাহ বিনতুল হারেছকে বিবাহ করেন। ইতিপূর্বে তাঁর দু’বার বিয়ে হয়েছিল এবং এ সময় তিনি বিধবা ছিলেন। তিনি হযরত খালেদ ইবনু ওয়ালীদের আপন খালা এবং রাসূলের চাচা আববাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের আপন শ্যালিকা ছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাসের মা উম্মুল ফযল ছিলেন তার আপন বড় বোন।
বিধবা হওয়ার পরে আববাস তার বিষয়ে আল্লাহর রাসূলকে ইতিপূর্বে জানিয়েছিলেন। সেমতে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) জা‘ফর ইবনু আবী ত্বালেবকে আগেই মক্কায় পাঠিয়ে দেন। চাচা আববাসের দায়িত্বে বিবাহের যাবতীয় ব্যবস্থা সম্পন্ন হয় এবং যথাসময়ে বিবাহ হয়ে যায়। মক্কা থেকে বেরিয়ে আসার সময় আববাস-এর গোলাম আবু রাফে‘ যে গোপনে মুসলমান ছিল, তাকে দায়িত্ব দিয়ে আসেন যাতে মায়মূনাকে সওয়ারীতে বসিয়ে রাসূলের কাছে নিয়ে আসে। সেমতে তাঁকে ‘সারফে’ পৌঁছে দেওয়া হয়। যেখানে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কাফেলা সহ অবস্থান করছিলেন। [7]
ফুটনোট:
[1] ফাৎহুল বারী ৭/৫৭২ হা/৪২৫২-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য; ‘যুদ্ধ বিগ্রহ’ অধ্যায়-৬৪, ‘ক্বাযা ওমরাহ’অনুচ্ছেদ-৪৩। [2] বুখারী হা/৪২০৬; মুসলিম হা/১২৬৬।
[3] তিরমিযী ‘শিষ্টাচার ও অনুমতি প্রার্থনা’ অধ্যায়, ‘কবিতা আবৃত্তি’ অনুচ্ছেদ হা/২৮৪৭; নাসাঈ হা/২৮৭৩।
[4] মুসলিম হা/১২৬৬।
[5] আবুদাঊদ হা/২৩২৪।
[6] আহমাদ হা/৭৭০; ছহীহাহ হা/১১৮২।
[7] যাদুল মা‘আদ ৩/৩২৮-২৯।
খায়বর যুদ্ধ
(৭ম হিজরীর মুহাররম মাস)
রওয়ানা:
হুদায়বিয়ার সন্ধি শেষে মদীনায় ফিরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পূরা যিলহাজ্জ ও মুহাররম মাসের অর্ধাংশ এখানে অবস্থান করেন। অতঃপর মুহাররম মাসের শেষভাগে কোন একদিন খায়বর অভিমুখে যাত্রা করেন। মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত তিনটি শক্তি- কুরায়েশ, বনু গাত্বফান ও ইহুদী- এগুলির মধ্যে প্রধান কুরায়েশদের সাথে হোদায়বিয়ার সন্ধির ফলে বনু গাত্বফান ও বেদুঈন গোত্রগুলি এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়ে।
বাকী রইল ইহুদীরা। যারা মদীনা থেকে বিতাড়িত হয়ে ৬০ বা ৮০ মাইল উত্তরে খায়বরে গিয়ে বসতি স্থাপন করে এবং সেখান থেকেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে সকল প্রকারের ষড়যন্ত্র করে। বরং বলা চলে যে, খায়বর ছিল তখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সকল ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু।
যুদ্ধ শুরু ও নায়েম দুর্গ জয়:
রাতের বেলা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘কাল আমি এমন একজনের হাতে পতাকা দেব, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে এবং যাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালবাসেন’। [5]
সকালে সবাই রাসূলের দরবারে হাযির হলেন। প্রত্যেকের ধারণা পতাকা তার হাতে আসবে। এমন সময় রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘আলী কোথায়’? সবাই বলল, চোখের অসুখের কারণে তিনি পিছনে পড়েছেন। রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘তার কাছে লোক পাঠাও’। অতঃপর তাকে আনা হল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজ মুখের লালা তার চোখে লাগিয়ে দিলেন এবং তার জন্য সুস্থতার দো‘আ করলেন। ফলে তিনি এমনভাবে সুস্থ হলেন যেন ইতিপূর্বে তার চোখে কোন অসুখ ছিল না।
অতঃপর রাসূল (সাঃ) তার হাতে পতাকা দিয়ে বললেন, ‘ধীরে-সুস্থে এগিয়ে যাও ও তাদের মুখোমুখি অবস্থান নাও’। অতঃপর তাদেরকে ইসলামের প্রতি দাওয়াত দাও এবং জানিয়ে দাও আল্লাহর হক হিসাবে তাদের উপরে কি কি বিষয় ওয়াজিব রয়েছে। ‘আল্লাহর কসম! যদি আল্লাহ পাক তোমার দ্বারা একজন লোককেও হেদায়াত দান করেন, তবে সেটি তোমার জন্য মূল্যবান লাল উটের চাইতে উত্তম হবে’। [6]
অতঃপর হযরত আলী সেনাদল নিয়ে খায়বরের শ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক মযবুত বলে খ্যাত ‘নায়েম’দুর্গের সম্মুখে উপস্থিত হলেন ও তাদেরকে প্রথমে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। ইহুদীরা এই দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করল এবং তাদের নেতা মারহাব দর্পভরে কবিতা বলে এগিয়ে এসে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহবান জানালো। বীরকেশরী মারহাবকে এক হাযার যোদ্ধার সমকক্ষ মনে করা হত। মারহাবের দর্পিত আহবানে সাড়া দিয়ে পাল্টা কবিতা বলে আমের ইবনুল আকওয়া‘ ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
কিন্তু তাঁর তরবারি আকারে ছোট থাকায় তার আঘাত মারহাবের পায়ের গোছায় না লেগে উল্টা নিজের হাঁটুতে এসে লাগে। যাতে তিনি আহত হন ও পরে মৃত্যুবরণ করেন। নিজের আঘাতে মৃত্যু হওয়ায় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন যে, তিনি দ্বিগুণ ছওয়াবের অধিকারী হবেন।[7]
এরপর মারহাব পুনরায় গর্বভরে কবিতা আওড়াতে থাকে ও মুসলিম বাহিনীর প্রতি দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহবান জানাতে থাকে। তখন প্রধান সেনাপতি আলী (রাঃ) তার দর্প চূর্ণ করার জন্য নিজেই এগিয়ে গেলেন এবং গর্বভরে কবিতা বলে সিংহের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে এক আঘাতেই শেষ করে দিলেন। এভাবে তাঁর হাতেই মূলতঃ ‘নায়েম’ দুর্গ জয় হয়ে গেল।
অন্যান্য দুর্গ জয়:
নায়েম দুর্গ জয়ের পর দ্বিতীয় প্রধান দুর্গ ছা‘ব বিন মু‘আয দুর্গটি বিজিত হয় হযরত হুবাব বিন মুনযির আনছারী (রাঃ)-এর নেতৃত্বে তিনদিন অবরোধের পর। এই দুর্গটি ছিল খাদ্য সম্ভারে পূর্ণ। আর এই সময় মুসলিম সেনাদলে দারুণ খাদ্য সংকট দেখা দেয়। তখন এই দুর্গটি জয়ের জন্য আল্লাহর নিকটে রাসূল (সাঃ) বিশেষ দো‘আ করেন এবং সেদিনই সন্ধ্যার পূর্বে দুর্গ জয় সম্পন্ন হয়। এই সময় ক্ষুধার তাড়নায় মুসলিম সেনাদলের কেউ কেউ গাধা যবহ করে তার গোশত রান্না শুরু করে দেয়।
এ খবর রাসূলের কর্ণগোচর হলে তিনি গৃহপালিত গাধার গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ করে দেন। এই দুর্গ থেকে সেই আমলের প্রচলিত কিছু ট্যাংক ও কামান (মিনজানীক্ব ও দাববাবাহ) হস্তগত হয়। পরে তাদের উপরে কামানের গোলা নিক্ষেপের হুমকি দিলে ১৪ দিন পর তারা বেরিয়ে এসে আত্মসমর্পণ করে ও সন্ধির প্রস্তাব দেয়। অতঃপর সন্ধি চুক্তির মাধ্যমে ‘কাতীবাহ’ অঞ্চলের তিনটি দুর্গ বিজিত হয়। এভাবে খায়বর বিজয় সম্পন্ন হয়।
সন্ধির আলোচনা:
‘কাতীবাহ’ অঞ্চলের বিখ্যাত ‘ক্বামূছ’ দুর্গের অধিপতি মদীনা হতে ইতিপূর্বে বিতাড়িত বনু নাযীর গোত্রের নেতা আবুল হুক্বাইক্ব-এর দুই ছেলে সন্ধির বিষয়ে আলোচনার জন্য রাসূলের নিকটে আসেন। আলোচনায় স্থির হয় যে, দুর্গের মধ্যে যারা আছে, তাদের সবাইকে মুক্তি দেওয়া হবে। তাদের সোনা-রূপাসহ অন্যান্য সকল সম্পদ মুসলমানদের অধিকারভুক্ত হবে। ইহুদীরা সপরিবারে দুর্গ ত্যাগ করে চলে যাবে। সুনানে আবুদাঊদের বর্ণনায় এসেছে যে, নিজ নিজ বাহনের উপরে যতটুকু মাল-সম্পদ নেওয়া সম্ভব ততটুক নেওয়ার অনুমতি তাদের দেওয়া হয়। [10]
ছাফিয়াহর সাথে রাসূলের বিবাহ:
কেনানাহ বিন আবুল হুকাইকের নব বিবাহিতা স্ত্রী ছাফিয়া বিনতে হুয়াই বিন আখত্বাব বন্দী হন। দাসী হিসাবে প্রথমে তাকে দেহিইয়া কালবীকে দেয়া হয়। পরক্ষণেই নেতৃকন্যা হিসাবে তাকে রাসূলের ভাগে দেওয়া হয়। রাসূল (সাঃ) তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তিনি ইসলাম কবুল করেন। অতঃপর তাকে মুক্ত করে তিনি তাকে বিবাহের মাধ্যমে স্ত্রীর মর্যাদা দান করেন।
এই মুক্তি দানকেই তার মোহরানা হিসাবে গণ্য করা হয়। অতঃপর মদীনায় ফেরার পথে ‘ছাহবা’ (الصهباء) নামক স্থানে পৌঁছে ‘ছাফিয়া’ হালাল হলে তার সঙ্গে সেখানে তিনদিন বাসর যাপন করেন। [11]
রাসূলকে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা:
খায়বর বিজয়ের পর রাসূল (সাঃ) যখন একটু নিশ্চিন্ত হলেন, তখন বনু নাযীর গোত্রের অন্যতম নেতা ও কোষাধ্যক্ষ সালাম বিন মুশকিমের স্ত্রী যয়নব বিনতুল হারেছ তাকে বকরীর ভূনা রান হাদিয়া পাঠায়। সে আগেই জেনে নিয়েছিল যে, রাসূল (সাঃ) রানের গোশত পসন্দ করেন। এজন্য উক্ত মহিলা উক্ত রানে ভালভাবে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল। রাসূল (সাঃ) গোশতের কিছু অংশ চিবিয়ে ফেলে দেন, গিলেননি। অতঃপর বলেন, ‘এই হাড্ডি আমাকে বলছে যে, সে বিষ মিশ্রিত’।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তখন উক্ত মহিলাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে সে কৈফিয়ত দিয়ে বলে, এর দ্বারা আমার উদ্দেশ্য ছিল এই যে, যদি এই ব্যক্তি বাদশাহ হন,তাহলে আমরা তার থেকে নিষ্কৃতি পাব। আর যদি নবী হন, তাহলে তাকে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হবে’। তখন রাসূল (সাঃ) তাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু সাথী বিশর ইবনুল বারা বিন মা‘রূর এক গ্রাস চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছিলেন। যাতে তিনি মারা যান। ফলে তার বদলা স্বরূপ ঐ মহিলাকে হত্যা করা হয়। [13]
খায়বরের ভূমি ইহুদীদের হাতে প্রত্যর্পণ ও সন্ধি:
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইহুদীদেরকে মদীনার ন্যায় খায়বর হতেও নির্মূল করতে চেয়েছিলেন এবং সেমতে কাতীবাহর ইহুদীরা সবকিছু ফেলে চলে যেতে রাযীও হয়েছিল। কিন্তু ইহুদী নেতারা এক পর্যায়ে রাসূলের নিকটে আবেদন করল যে, আমাদের এখানে থাকতে দেওয়া হৌক, আমরা এখানকার জমি-জমা দেখাশুনা ও চাষাবাদ করব ও আপনাদেরকে ফসলের অর্ধেক ভাগ দেব।
এখানকার যমীন সম্পর্কে আমাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা আপনাদের চেয়ে বেশী রয়েছে’। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাদের এ প্রস্তাব বিবেচনা করলেন এবং উৎপন্ন ফসলের অর্ধাংশ প্রদানের শর্তে রাযী হলেন। সেই সাথে বলে দিলেন যতদিন তিনি চাইবেন, কেবল ততদিনই এ চুক্তি বহাল থাকবে। প্রয়োজনবোধে যেকোন সময় এ চুক্তি তিনি বাতিল করে দিবেন। অতঃপর উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহাকে দায়িত্ব দেন।
গণীমত বণ্টন:
খায়বরের যুদ্ধে ভূমি সহ বিপুল পরিমাণ গণীমত হস্তগত হয়। যার অর্ধেক অংশ ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের জন্য রেখে দিয়ে বাকী অর্ধেক ১৮০০ ভাগে ভাগ করা হয়। হোদায়বিয়ার ১৪০০ সাথীর মধ্যে উপস্থিত ও অনুপস্থিত সকলের জন্য অংশ নির্ধারিত ছিল। এদের মধ্যে ২০০ জন ছিলেন অশ্বারোহী। প্রত্যেক পদাতিকের জন্য একভাগ ও ঘোড়ার জন্য দু’ভাগ।
এক্ষণে ১২০০ পদাতিকের জন্য ১২০০ ভাগ এবং ২০০ অশ্বারোহীর জন্য ৬০০ ভাগ, সর্বমোট ১৮০০ ভাগে গনীমত বণ্টন করা হয়। উক্ত হিসাবে আল্লাহর রাসূলও একটি ভাগ পান।
ফুটনোট:
[1] বুখারী হা/৪১৯৬; মুসলিম হা/১৮০২।
[2] বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৩০৩।
[3] ওয়াকেদী, মাগাযী পৃঃ ২১২।
[4] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৩২৯ হাদীছ ছহীহ, সনদ মুরসাল।
[5] মানছূরপুরী বলেন, প্রথমে মাহমূদ বিন মাসলামাহর নেতৃত্বে পরপর পাঁচদিন অভিযান ব্যর্থ হবার পর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) উক্ত কথা বলেন এবং আলীকে দায়িত্ব দেন (রাহমাতুল ১/২২০-২২২)। কিন্তু মুবারকপুরী এতে ভিন্নমত পোষণ করেন এবং অধিকাংশ বিদ্বানের নিকটে গৃহীত মত হিসাবে বইয়ে প্রদত্ত বক্তব্য পেশ করেন।
[6] বুখারী হা/৪২১০।
[7] বুখারী হা/৩৮৭৫, ৫৬৮২, ৬৩৮৩; মুসলিম হা/৩৩৮৩।
[8] মুসলিম হা/১৮০৭।
[9] যাদুল মা‘আদ ৩/২৮৭।
[10] আবুদাঊদ হা/৩০০৬, সনদ হাসান।
[11] বুখারী হা/৪২১১।
[12] যাদ ২/১৩৭; ইবনে হিশাম ২/৩৩৬।
[13] বুখারী হা/৩১৬৯; সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৩৩৭; ফিক্বহুস সীরাহ ৩৪৭ পৃঃ, সনদ ছহীহ।
Leave a Comment
নিচে কমেন্ট বক্স এ আপনার মূল্যবান মতামত দিন। যা লেখকের অনুপ্রেরণা জোগাবে ইনশা-আল্লাহ।